ঋতুপর্ণ
চিত্তে যে আছে সে দূরে এতো ভ্রম বই কিছু না।
সে আঁখি ধ্রুবতারা তার শুভ আশিস সদা আছে আমার সাথে। "অন্ধকারের উত্স
হতে উত্সারিত আলো সকল দ্বন্দ্ববিরোধ-মাঝে জাগ্রত পথের ধুলায় বক্ষ পেতে রয়েছে যেই গেহ
সমরঘাতে অমর করে রুদ্রনিঠুর স্নেহ মৃত্যু আপন পাত্রে ভরি বহিছে যেই প্রাণ। সেই তো তোমার
প্রাণ ।সব ফুরালে বাকি রহে অদৃশ্য যেই দানবিশ্বজনের পায়ের তলে ধুলিময় যে ভূমি সেই তো
স্বর্গভূমি ।সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছ তুমি সেই তো আমার তুমি " এসব কথা প্রযোজ্য
ঋতুরপর্ণের জন্যই। এমনটাই ছিল আমাদের ঋতুপর্ণ। আমার প্রাণের বন্ধু কাছের ঋতুপর্ণ ঘোষ
. আমার বন্ধুত্বের সূত্রধর. ঋতুর সাথে আমার একটা আত্মিক সম্পর্ক। ঋতুপর্ণ ছিল এক শিশুসুলভ
প্রাণোচ্ছ্বল সংবেদনশীল শিল্পমনস্ক নরম মনের মানুষ। বিশ্ব জগৎ-এ যেখানে কুশিক্ষায় শিক্ষিত লোকে ভর্তি।. সেখানে ঋতুপর্ণ
ছিল একজন শিক্ষিত মনের মানুষ। ওর জ্ঞানের কোনো তুলনা নেই। এক অগ্রণী চিত্র পরিচালক
ঋতুপর্ণ ছিল এক অসামান্য দক্ষ শিল্পী এবং অসাধারণ মানুষ।
“আধুনিক
মানুষরা” আধুনিকতার বড়াই করি কিন্তু
আধুনিকতাকে এখনো অন্তরে ধারণ
করতে পারিনি।তাই ঋতুপর্ণ ঘোষকে নিয়ে বিশেষ করে
খুব একটা লেখালেখি হয়
না।ঋতুপর্ণ ঘোষকে আমরা একটু এড়িয়ে
চলি। ওর কথা উঠলে
আমাদের ভ্রু-যুগল আপনিই
কুঞ্চিত হয় অথবা ঠোঁটে
বঙ্কিম হাসি দেখা দেয়।ব্যক্তিগত
সংকীর্ণতা কাটিয়ে একজন মানুষের প্রজ্ঞা, তাঁর কর্ম, অবদান, শৈল্পিক
দক্ষতাকে প্রাধান্য দিতে এত আমাদের
কেন কার্পণ্য?
ঋতুপর্ণের জন্ম
কলকাতায় ১৯৬৩ সালের ৩১
অগস্ট । বাবা-মা উভয়েই চলচ্চিত্র
জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাবা সুনীল ঘোষ
ছিলেন তথ্যচিত্র-নির্মাতা ও চিত্রকর। ঋতুপর্ণ
ঘোষ সাউথ পয়েন্ট হাই
স্কুল শেষ করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ডিগ্রি
অর্জন করে।চলচ্চিত্র জগতে আসার আগে
ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিল কলকাতার
একজন "অ্যাডভারটাইসমেন্ট কপিরাইটার"।১৯৮০-র দশকে যে
সময় কলকাতায়
ইংরেজি ও হিন্দি বিজ্ঞাপনগুলি
বাংলায় অনুবাদ করে চালানো হত।
সেই সময় ঋতুপর্ণ ঘোষ
বাংলা বিজ্ঞাপনের জগতে বেশ কিছু জনপ্রিয় শ্লোগান লিখে বাংলা বিজ্ঞাপনে নতুন ধারার প্রবর্তন
করে । ঋতুপর্ণ বাংলায় স্বতন্ত্র বিজ্ঞাপনী
শ্লোগানের ধারা সৃষ্টি করেন।ওর সৃষ্ট বিজ্ঞাপনগুলির
মধ্যে শারদ সম্মান ও বোরোলিনের বিজ্ঞাপনদুটি বিশেষ জপ্রিয়তা পেয়েছিলো । বিজ্ঞাপনী চিত্র
নির্মাণের মাধ্যমে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিল, যা পরে ওকে ছবি নির্মাণে বিশেষ সহায়ক
হয়।
ঋতুপর্ণ
ঘোষ ছিল সত্যজিৎ রায়ের
অনুরাগী। বরাবরই চলচিত্রের প্রতি
বিশেষ ঝোঁক ছিল। আর সেই অনুরাগ পরবর্তীতে ঋতুপর্ণ হয়ে ওঠে এক দক্ষ চিত্র নির্মাতা।
ঋতুপর্ণ
ঘোষের পরিচালনায় প্রথম ছবি মুক্তি পায়
"হিরের আংটি" ১৯৯২ সালে । ১৯৯৪ সালে
তাঁর দ্বিতীয় ছবি উনিশে এপ্রিল মুক্তি পায়। এই ছবিতে এক মা ও তাঁর মেয়ের পারস্পরিক
সম্পর্কের কাহিনি দেখানো হয়েছে। ছবিটি সমালোচকদের প্রশংসা পাওয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবেও
সফল হয়। এই ছবি ১৯৯৫ সালে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র
হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পায়।১৯৯৭ সালে দহন মুক্তি পায় । ১৯৯৮ সালে এই
ছবি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায় এবং এই ছবির দুই অভিনেত্রী ইন্দ্রাণী হালদার ও ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত একসঙ্গে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসাবে জাতীয় পুরস্কার পান। দহন ছবির বিষয়বস্তু কলকাতার
রাস্তায় এক মহিলার ধর্ষিত হওয়ার কাহিনি। অপর একটি মেয়ে সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।
সে এগিয়ে আসে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু সমাজ ও ধর্ষিতার পরিবার
পরিজনের ঔদাসিন্যে সে হতাশ হয়।সমাজের বাঁধা নিয়ম কানুনের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ঋতুপর্ণ যে আমাদের
সমাজ কতটা মেকি বানানো। ১৯৯৯
সালে মুক্তি পাওয়া অসুখ ছবিতে এক অভিনেত্রী ও তাঁর আয়ের উপর অনিচ্ছুকভাবে নির্ভরশীল
বাবার সম্পর্ক দেখানো হয়। এটি শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। ২০০০
সালে মুক্তি পায় বাড়িওয়ালি । এই ছবির জন্য
কিরণ খের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়।
২০০০
সালে মুক্তিপ্রাপ্ত "উৎসব" ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার
পায়
ঋতুপর্ণ
২০০৩ সালে নির্মাণ করে রহস্য ছবি "শুভ মহরত " আগাথা ক্রিস্টির দ্য মিরর ক্র্যাকড
ফ্রম সাইড টু সাইড অবলম্বনে।ওই বছরই ঋতুপর্ণ তৈরি করেন চোখের বালি। ও. হেনরির ছোটোগল্প
"দ্য গিফট অফ দ্য ম্যাজাই” অবলম্বনে নির্মিত ২০০৪ সালে ঋতুপর্ণের প্রথম হিন্দি
ছবি রেনকোট মুক্তি পায়। ছবিটি শ্রেষ্ঠ হিন্দি ছবি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। ২০০৫
সালে তাঁর বাংলা ছবি অন্তরমহল মুক্তি পায়। এটি ব্রিটিশ আমলের এক জমিদার পরিবারের গল্প।
২০০৭
সালে দ্য লাস্ট লিয়ার মুক্তি পায়। এটি একটি প্রাক্তন শেক্সপিয়ারিয়ান থিয়েটার অভিনেতার
জীবনের গল্প। অমিতাভ বচ্চন কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন।
২০০৮
সালে মুক্তি পায় খেলা। এটি মানব সম্পর্কের গল্প। এটি মণীষা কৈরালার প্রথম বাংলা ছবি।
এই বছরই মুক্তি পায় তাঁর সব চরিত্র কাল্পনিক। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও বিপাশা বসু
অভিনীত এই ছবিটি শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়।
২০০৯
সালে যীশু সেনগুপ্ত, অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, দীপংকর দে ও মমতা শঙ্কর অভিনীত ছবি আবহমান
মুক্তি পায়। এটি শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। ঋতুপর্ণ ছবি নির্মাণের পাশাপাশি অভিনয় পারদর্শিতা ছিল বিষের
লক্ষণীয়। প্রথম অভিনয় করেন ওড়িয়া ছবি কথা দেইথিল্লি মা কু-তে। হিমাংশু পারিজা পরিচালিত
এই ছবিটি মুক্তি পায় ২০০৩ সালে। ২০১১ সালে তিনি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের আরেকটি প্রেমের
গল্প এবং সঞ্জয় নাগের মেমরিজ ইন মার্চ ছবিতে অভিনয় করেন।
ঋতুপর্ণের
শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি চিত্রাঙ্গদা। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদার কাঠামো অবলম্বনে
নির্মিত। এটি ৬০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বিশেষ জুরি পুরস্কার
পায়।
২০১৩
সালের ৩০ মে তাঁর কলকাতার বাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঋতুপর্ণ চলে যায় আর না ফেরার
দেশে।
সানজিদা রুমি কর্তৃক গ্রথিত



লেখনীর সূত্রপাত শুরু এখান থেকে 







ঋতুপর্ণ ঘোষ একজন দক্ষ ছবি নির্মাতা। একজন দক্ষ মানুষ। তাকে নিয়ে আমরা বিতর্কিত করি। কিন্তু চিত্তে ঋতুপর্ণ। দারুন দারুন
ReplyDeleteএত বড় একজন মানুষ কে নিয়ে যখন বিতর্ক হয় খুব খারাপ লাগে। চিত্তে ঋতুপর্ণ ? খুব ভালো লাগলো
ReplyDelete