যদি হাসতে ভালোবাসো
না হয় একটুখানি হাসো
“রাজা খাবেন
বউখুদা”
বদরুদ্দোজা চৌধুরী
এক ছিল এক রাজা। সবাই বলতো মটুক রাজা। রাজাটি লোক হিসাবে মোটামুটি ভালোই ছিলেন- কিন্তু একটু ঝোকে চলতেন এই যা। বড় রানীর বাচ্চা হয়নি। অল্প বয়সী ছোট রানীর একটাই বাচ্চা, নাম তার চপল কুমার।
দুই রানী এবং রাজপুত্র নিয়ে রাজার সংসার। রাজা রাজ্য চালান একপাল মন্ত্রী নিয়ে। রাজা প্রায়ই ভাবেন মন্ত্রীদের বুদ্ধিশুদ্ধি নিয়ে।
চলে যাচ্ছে রাজত্ব। চলে যাচ্ছে রাজার সংসার।
বড় রানীর বাচ্চা নেই। নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ। ছোট রানী বয়সে অনেক ছোট। বড় রানী তাকে স্নেহ করেন। আদর করেন চপল কুমারকে, যেন তাঁর নিজের ছেলে। তাঁর হিংসা নেই কোন।
ছোট রানী ভরদুপুরে সোনার পালঙ্কে রূপোর মাদুর বিছিয়ে শুয়েছেন। ঘুম আসছে না, তাই শুয়ে শুয়ে নানান গল্প করছেন তার বাপের বাড়ির কাজের মেয়ে রূপসীর সঙ্গে।
- ও রুপসী, তোর বাপের বাড়ি কী কী মজার খাবার খেতিস বলতো? হঠাৎ রানী প্রশ্ন করেন।
- রূপসী দাসী পা টিপছে আর হাসছে, কী আর খেতাম রানীমা। আমরা গরিব মানুষ, রাজবাড়ীর পোলাও কোর্মা পাব কোথায়?
- তা নইলে কি মজা খেতিস? রানীমার ফের প্রশ্ন।
- রূপসী বললো, এই আর কী! কখনো গরম ভাত, কখনো পান্তাভাত, চ্যাপা শুটকি, তরকারির খোসার ভর্তা, কখনো গুড়ো মাছ এইসব। আমরা গরিব মানুষ না!
চট্ করে রানীর মাথায় খেয়াল চেপে যায়।
- রূপসী, তুই আমাকে তোদের খাওয়া রান্না করে খাওয়াবি? রাজবাড়ীর পোলাও-কোর্মা ছাইপাশ খেতে খেতে আমার মুখ পঁচে গেছে। আর তো ভালো লাগে না। তোদের মরিচ বাটা, কালিজিরা ভর্তা, পান্তাভাত, শুটকি ভর্তা - খাওয়াবি?
শুনে রূপসীর গালে হাত।
- ওমা বলেন কি ছোটরানী! মহারাজা শুনলে আমাকে দশ টুকরো করে ফেলবেন। রাজবাড়ীতে পান্তা-শুটকি-মরিচ বাটা? তাই কি হয় কখনো? আমায় মাফ করবেন রানীমা।
দূর বোকা, রাজামশাইকে আমি হাত করবো। আমরা দুজনেই খাবো। ছোট রানীমা অভয় দিলেন।
- রানীমা, রান্না ঘরে ঢুকে এসব কথা বললে আপনার শ'খানেক বাবুর্চি আমাকে কিল মারতে মারতে মেরেই ফেলবে গো। বললো রূপসী দাসী।
- শোন্ রূপসী, পান্তা ছেড়ে দে। ওটা রাজবাড়ীতে চলবে না। কিছু একটা রানী ভাবতে থাকলেন গালে হাত দিয়ে। রূপসীও অনেকক্ষণ ভাবলো। চট্ করে তার মনে পড়লো তাদের গাঁয়ের জোতদারের ছেলের বউয়ের কথা। রূপসী ওই বাড়িতে আগে কিছুদিন কাজ করেছিল।
জোতদারের ছেলের বউ ভোর সকালে এক দারুণ মজার জিনিস রান্না করে কাজের মেয়েদের নিয়ে একসাথে খেতো। দারুণ মজাদার। মুটকি শাশুড়িটা বউটাকে খেতে দিতো না বলে বউ নিজের শাশুড়ির চাল বেছে বেছে খুদটা খাঁটি সরষের তেল, কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, লবণ দিয়ে দারুণ একটা খাবার রান্না করতো।
তোমরা “বউখুদার জন্মকথা” বইটাতে এ খাবারের গল্পটা পড়তে পারো।
- ভোর হবার আগেই ঐ তেল খুদের পোলাও পাঁচ ছ’রকমের ভর্তা দিয়ে ওরা সবাই খেতো। কালিজিরার ভর্তা, পটল খোসার ভর্তা, মূলা বেলে মাছের ভর্তা, মরিচ বাটা, তেঁতুলের ভর্তা এসব দিয়ে গরম গরম খুদের পোলাও, খেতে লাগত দারুণ! তুলনাহীন! সবাইকে ঢক ঢক করে পানি খেতে হতো ঝালের তোড়ে। রূপসী দাসীর হঠাৎ মনে পড়তেই সে ছোট রানীকে কথাটা খুলে বলল।
- রানীমা, যদি খেতে চান ঐ জোতদার বাড়ির ছেলের বউকে ডেকে আনলে খাবারটা রান্না করে আপনাকে খাওয়াতে পারে সে। পরামর্শ দিলো রূপসী দাসী।
ছোট রানীমা বললেন - সত্যি করে বল রূপসী খেতে কেমন মজা? সত্যি করে বলবি কিন্তু?
রূপসী বললো - সত্যি, সত্যি, সত্যি তিন সত্যি। মাথার কিরা, আমার বাপের জন্মে অমন মজা খাইনি। রাগ করবেন না রানীমা। এর কাছে কোথায় লাগে রাজবাড়ীর পোলাও-কোর্মা, কোপ্তা কালিয়া? তবে ঝালটা একটু বেশি এই যা।
- ছোট রানী দারুণ মজা পেলেন রূপসীর কথায়। ভাবনা শুধু রাজাকে নিয়ে। রাজাকে আগে কথাটা বলতে হয়। রাজাকে প্রথমে রাজী করাতে হবে - যেমন করে হোক। তবেই না!
রাতের বেলা রাজা খাওয়া-দাওয়া সেরে যখন শুয়ে পড়লেন তখন ছোটরানী কথাটা পাড়লেন।
ছোট রানী বললেন - রাজামশাই, ঘুমালে নাকি?
- কেন? ঘুম জড়ানো রাজার গলার আওয়াজ।
- বলছিলাম কি, রোজ রোজ ঐ এক পোলাও কোপ্তা খেতে ভালো লাগে না।
- রাজা বললেন - তাহলে কী খাবে? রুটি গোশত্! রাজা ঘুম জড়ানো গলায় রানীর সাথে মশকরা করতে চাইলেন।
- ছিঃ মাউরা খানা কেন খেতে চাইবো? দেশী খাবার নেই কোন? রানীর জবাব।
- যেমন? রাজা বললেন।
- যেমন পান্তা, ভর্তা, শুঁটকি . . . রানী বলেই চলেছেন।
রাজা ধাড়াক করে বিছানায় উঠে বসলেন। রানীর কি রাত জেগে মাথা গরম হয়ে গেলো নাকি? রাজা উঠে বসে রানীর দিকে তাকিয়ে নিজের হাত রানীর মাথায় চাঁদির মাঝখানে রাখলেন।
রানী বললেন, ওমা আমার চান্দিতে কি দেখছো?
- তোমার মাথা গরম হয়েছে কিনা তাই দেখছি। আশ্চর্য! মাথা তো একদম ঠান্ডা, রাজা অবাক।
রাজা বললেন, তবে তুমি কি ঠান্ডা মাথায় শুটকি আর মরিচ ভর্তা খেতে চাইছো? তাও আমার এই রাজ্যের এই রাজপ্রাসাদে! লোকে জানলে ছিঃ ছিঃ করবে না? বলো কি ছোট রানী?
- রানী নাছোড়বান্দার মতো ডানে-বাঁয়ে মাথা দুলিয়ে বললেন - না, একদম ছিঃ ছিঃ করবে না। কারণ জিনিসটা হবে খুব গোপনে।
পান্তা ভাত নয় - আমরা খাব খুদ, সরষের তেল, মরিচের পোলাও যার নাম “বউখুদা”। দারুণ খাবার!
রানী রূপসী দাসীর কাছে শোনা বউখুদার সঙ্গে পাঁচ রকমের ভর্তা খাবার এমন রসিয়ে রসিয়ে গল্প করে শোনালো যে রাজার সত্যি সত্যি জিবে পানি এসে গেলো। রাজা ফুৎ ফুৎ করতে লাগলেন।
রাজা বললেন, সত্যি সত্যি খাওয়াবে এমন মজার খাবার রানী? তাহলে কালকেই জোতদারের বউকে আনতে রাজবাড়ীর বড়কান্দাজ দিয়ে পালকি পাঠিয়ে দিই?
- রানী খুবই খুশি। রাজাকে তিনি ঠিক হাত করে ফেলেছেন। চমৎকার।
এরপর একদিন জোতদারের বউ পালকী চড়ে বেহারাদের হুম হুমা শুনাতে শুনাতে রাজবাড়ীর অন্দরমহলে এসে পৌঁছালো। তাকে ছোট রানীর ঘরে নিয়ে এলো রূপসী দাসী। রূপসী রানীর কাছে আনার আগেই জোতদারের বউকে জানিয়ে দিলো রানী কেন তাকে ডেকেছিল।
জোতদারের বউয়ের তো গালে হাত। রাজবাড়ীতে রাঁধতে হবে তার “বউখুদা”!! “বউখুদা” রান্না করতে যা দরকার রাজপ্রাসাদে তা সে কোথায় পাবে? এই ধরো না ভাঙ্গা চালের খুদ, সরষের তেল, কালিজিরা, চ্যাপা শুটকির ভর্তা, চাটগাঁয়ের লালমরিচ, মূলা ঝুরি, বেলে মাছ - এগুলো কী রাজবাড়ীতে খায় নাকি?
ছোট রানী তাকে সাহস দিলেন। শোনো জোতদারের ছেলের বউ, রূপসী দাসী তোমার সাথে তোমাদের গাঁয়ের বাড়ি গিয়ে ঐসব আনাজপাতি, মালমশলা জোগাড় করবে। তারপর তরঙ্গ ভরে তালাচাবি দিয়ে তোমার সব মালামাল নিয়ে আসবে। কাকপক্ষীও জানবে না।
জোতদারের বউ বললো - আসার পথে বাড়ি থেকে মাটির তোলা উনুনও নিয়ে আসা যাবে। রাজবাড়ীর রান্না ঘরে ঢুকে তো আর রান্না করা যাবে না? জানাজানি হয়ে গেলে কেলেংকারী হয়ে যাবে না?
এসব যেন কেউ জানতে না পায় এমন ব্যবস্থা করলেন ছোট রানী।
- তুমি অন্দরে আমার পাশের ঘরে রান্না করবে।
এইভাবে বউখুদা রান্নার ষড়যন্ত্র হলো।
কয়েকদিন পরে সব মালপত্রসহ বউটি আবার এসে হাজির হলো, এবার সঙ্গে ছিল রূপসী দাসী। রাজামশাই মাঝে মাঝে তাগাদা দিচ্ছিলেন।
- কই রানী, তোমার “বউখুদা” কতদূর? কবে হবে? আমার জিব তো পানিতে জব জবা হয়ে গেলো। ফুৎ ফুৎ ....
একদিন জোতদারবউ সত্যি সত্যি তোলা চুলোতে সব রান্না করে ফেললো সকাল সকাল। ততক্ষণে রাজা চলে গেছেন রাজসভায়, মন্ত্রীবর্গ নিয়ে করছেন কাম কাজ।
এদিকে রান্নাবান্না সারা। রাজা আছেন রাজসভায়। রাজাকে খবর দিতে হয় গরম গরম খুদের পোলাও খাবার জন্যে। কেমন করে খবর দেওয়া যায়?
খুদের পোলাও খেতে আসুন একথা বললে রাজার কি আর মান সম্মান থাকে? রাজা খাবে খুদের পোলাও - একথা কি রাজসভায় জোরেশোরে বলা যায়?
রানী পড়লেন মুশকিলে
রানী ভাবছেন আর ভাবছেন।
রাজাদের অনেক রাজভৃত্য থাকে মটুক রাজারও ছিল তাই। এর মধ্যে সবচেয়ে চালাক রাজভৃত্য ছিল এক নম্বর রাজভৃত্য। সে আবার ছড়াও কাটতে জানতো। নতুন ছড়া বানাতেও পারত।
রানী রাজভৃত্যকে ডেকে পাঠালেন- শোনো রাজভৃত্য, তোমাকে আজ বুদ্ধির পরীক্ষা দিতে হবে।
ছড়ায় ছড়ায় রাজার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তুমি বুঝবে আর রাজামশাইকে বোঝাবে এমন করে বলতে হবে।
মনে থাকবে তো সমস্ত ব্যাপারটা? রানী বুঝিয়ে বললেন রাজভৃত্যকে। রাজাকে তাড়াতাড়ি ডাকতে হবে।
অথচ কেউ যেন বুঝতে না পারে রাজামশাই খুদ খেতে আসছেন। রাজা রানীর ইজ্জতের প্রশ্ন, পারবে?
চালাক রাজভৃত্য হেসে বলে খুব পারবো,
একবার হুকুম দেন
সন্দেহ করেন ক্যান?
যাব আর আসবো
ফটাফট কাম সারবো।
ওর ছড়া শুনে রানী তো হেসে কুটি কুটি।
একটু পরে রাজভৃত্য গুটি গুটি পায়ে রাজসভায় হাজির। রাজসভা তখন জমজমাট। মন্ত্রী, ওমরাহ্, দেশী-বিদেশী লোকজনে ভরপুর।
রাজামশাইকে অন্দরমহলে নিয়ে যেতে হবে রাজভৃত্যকে। চাট্টিখানি কথা নয় এটা। সুতরাং ফন্দি মতো লম্বা একটা সালাম দিয়ে রাজভৃত্য রাজার সঙ্গে কথা শুরু করে দিলো ছড়ায় ছড়ায়। রাজাও কম যান না। তিনিও জবাব দিলেন ছন্দে ছন্দে।
রাজভৃত্য:
মহারাজ, ভয়ে কবো না নির্ভয়ে?
করজোড়ে করি নিবেদন -
রাজা:
নির্ভয়ে নির্ভয়ে
রাজভৃত্য, কহ দ্রত
বড় ব্যস্ত
ছাড়ো হে বচন।
রাজভৃত্য:
সাদাসিধা কবো মহারাজ,
না ধাঁধাঁয় ধাঁধাঁয়?
রাজা:
(ঈষৎ হেসে)
ধাঁধাঁয় ধাঁধাঁয়, মন্দ কি তায়?
শুধু বুদ্ধিমান যেন বুঝতে পায় -
না হয়, মন্ত্রীদের আজ পরীক্ষায় হয়ে যাক।
যদি বোকা হয় তবে ধরাই পড়ে যাক।
মন্ত্রীগণ:
(বাধিত হবার ভাব করে)
হেঃ হেঃ হেঃ মহারাজ
কথা নতুন নহে আজ
আমরা যে মহাবোকা, বোকা শিরোমণি
একথা হুজুর আপনি, আমরা, সবাই জানি
হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ
রাজা:
(ধমক দিয়ে)
থামাও তোমাদের হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ
কই হে রাজভৃত্য, জলদি বলো।
রাজভৃত্য:
(বিনয়ে হাত কচলে কচলে)
মহারাজ, সুসংবাদ করি নিবেদন -
রানীমা বললেন,
যেন শোনেন দিয়া মন।
মহারাজা:
রানীমা বললেন?
তবে কান পেতে দিই। বলো বলো।
মন্ত্রীবর্গ:
বলো না হে, বলো বলো। জলদি বলো।
রাজভৃত্য:
হুজুর নিবেদন বেশি কিছু নাই
সংক্ষেপে, তাও ধাঁধাঁয় কবো তাই।।
হুজুর ঐ যে চালমনির পুত্র খুদমণি রায়
আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চায়।
রাজা:
বটে বটে, কে বটে?
বলতো আবার
নামটা যেন শোনা শোনা আমার!
রাজভৃত্য:
হবে না কেন হুজুর?
অবশ্যই শোনা শোনা মহারাজ,
রানীমা বললেন -
আগে নাকি কথা ছিল আসবেন আজ।
রাজা তখনো ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারেননি। ভাবছেন তিনি। মন্ত্রীগুলো কিছুই না বুঝে কেবলই ডানে-বাঁয়ে মাথা দোলাচ্ছে এবং মাথায় টোকা মারছে।
মন্ত্রীবর্গ:
হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ
তাই তো, তাই তো বটে বটে বটে
ধাঁধাঁটা সত্যি সত্যি বেজায় খট্খটে।
রাজা:
(ধমকের সুরে)
চুপ চুপ চুপ চুপ!
বুদ্ধির ঢেঁকি সব একদম চুপ।
রাজভৃত্য:
হুজুর তবে আবার করি নিবেদন,
এখনো যদি ধাঁধাঁটা নাই বুঝে থাকেন।
মহারাজ, চালমনির পুত্র খুদমনি রায়
বাপের চেয়ে বেশ বেঁটে খাটো গায়ে পায়।
তিনি তো আপনার সাথেই সাক্ষাৎ করতে চায়।
রাজা:
আরো কিঞ্চিত বিশদ করে বলো
না হলে অন্দরেই চলো।
রাজভৃত্য:
হুজুর বলি তবে খুদমনি বাবুর দেরী নাহি সয়
দেরীতে গতর তার শীতল হয়ে যায়।
আসলে গরম কুটুম্ব যেমন অতিথি প্রিয় বটে
গরম মেজাজ মর্জি তাই তারে খাটে।
ঠিক যেন ঝাললংকা, তায় তেলে ভাজা
দেখা হলেই বুঝবেন মজা।
রাজা:
গৃহভৃত্য, খুদমনি মশাই কোন উপঢৌকন এনেছেন?
রাজভৃত্য:
আনবে না?
আলবৎ রাণীমার কাছেই যখন এসেছেন।
কিন্তু জিনিসগুলো যে ঈষৎ অন্যরকম
মন্ত্রীমশাইরা শুনলে হয়তো ঘাবড়ে যাবেন।
মন্ত্রীগণ:
(একসঙ্গে)
এ্যাঁ বলে কী, ঘাবড়ে যাবো? কি রকম কি রকম?
শুনি দেখি রকম সকম!
শুনি বিবরণ।
রাজভৃত্য:
শোনেন তবে, এনেছেন ভর্তা, বাটা, কালিজিরা।
মন্ত্রীগণ:
(অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে)
এ্যাঁ, ভর্তা? কালিজিরা?
ভাবছি আনবে সোনা দানা হীরা!
তাই নয় কালিজিরা!!
রাজা:
(চোখ বন্ধ করে এতক্ষণে মৃদু হাসছেন।
ধাঁধাঁটা তাঁর কাছে এবার পরিস্কার হয়ে গেছে)
বলো রাজভৃত্য আর কি বলবে বলো?
না হয় এখনই ভিতরেতেই চলো।
রাজভৃত্য:
শুধু নয় বাটা ভর্তা কালিজিরা
আরো আছে শুটকি ভর্তায় চ্যাপা-পুটিরা।
মন্ত্রীবর্গ:
(নাক বন্ধ করে যেন গন্ধ ঠেকাচ্ছে এমনি ভাব করে)
এ্যাঁ, চ্যাপা-পুটি, বলে কি?
আসলে লোকটি বদ্ধ পাগল নাকি?
রাজা:
(ধমকের সুরে)
মন্ত্রীরা সব চুপ, একদম চুপ।
যতো বুদ্ধির ঢেঁকি।
হ্যাঁ রাজভৃত্য, বাকী বিবরণ দ্রত বলো দেখি।
রাজভৃত্য:
বাটা ভর্তায় এনেছে পটল
ঝালে আনবে নিশ্চিত চোখের জল
মরিচ বাটা খাঁটি সরষের তেল
আজব ব্যাপার স্যাপার, যেন মাদারীর খেল।
আরো কিসব দারুণ দারুণ জিনিস
দেরীতে গেলে কে জানে
রানীমাই করে দেবে ফিনিশ।
মন্ত্রীবর্গ:
(একযোগে)
পটল ভর্তা, মরিচ ভর্তা?
লোকটা পাগল নাকি?
রাজা:
(রাগত স্বরে)
চুপ তোমরা, এক পাল ছাগল নাকি!
রাজভৃত্য:
মহারাজ, চালমনির পুত্র খুদমনি রায়
আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চায়
আসেন তো আসেন, না হয়
তিনি যে জুরান নগর যায়।
মন্ত্রীবর্গ:
এ্যাঁ, কোথায় যায়?
জুরান নগর যায়?
এটি কি পশ্চিম না পূর্বে
কোথায়? কোথায়?
রাজা:
না না তা কেন? তা কেন?
জুরান নগর যাবে কেন?
নিশ্চিত চিনেছি তারে
তিনি তো নয় যেন তেন।
তবে চলো চলো চলো।
(মন্ত্রীদের কথা কি আর বলবো বলো
চালাক চতুর পোজ-পাজ যতো বুদ্ধির ঢেঁকি।
বাইরে পাগড়ী পোশাক ভিতরেতে মেকি।
এদের নিয়ে দেশ চালানো এত সোজা নাকি!)
মহারাজ তাড়াহুড়া করে অন্দর মহলে চলে গেলেন।
অন্দরে ঢুকতেই মহারানীর তাড়া - মহারাজা, বললাম না খুদের তেলে ভাজা পোলাও তো গরম গরম খেতে হয়। আর একটু হলেই জুড়িয়ে ঠান্ডা হয়ে যেত। গরমের মজাটাই থাকতো না।
রাজা আমতা আমতা করে বললেন - রানী তোমার ধাঁধাঁটা বুঝতে একটু সময় লেগেছে, তাই।
যা হোক রাজা খেতে বসে গেলেন সোনায় মোড়া, রূপোর মাদুরে। কিন্তু একী আশ্চর্য! আজকের সোনার থালা নেই, রূপোর চামচ নেই, মতি বসানো রূপোর বাটি নেই! এসবের বদলে কি আছে জানো?
মাটির সানকি, মাটির খোরা, সাধারণ মাটির বাটিতে বউখুদা আর মাটির থালায় সাজানো সারি সারি ভর্তা।
রানী বউখুদা বারবার পাতে তুলে দিচ্ছেন রাজা খেয়েই যাচ্ছেন, খেয়েই যাচ্ছেন। খুদের তেলের পোলাও- সাথে প্রচুর শুটকি ভর্তা, কালিজিরা ভর্তা, চাটগাইয়া মরিচ ভর্তা, পটল খোসার ভর্তা, মূলা-বেলে মাছের ভর্তা, তেঁতুলের ভর্তা। ঝালে জিব জ্বলছে, পেট জ্বলছে, গলার নিচে ঘাম রাজার ভুড়ি গড়িয়ে নামছে।
ঝালের চোটে রাজার চোখ ছলছল। আঃ উঃ করছেন তিনি। কিন্তু, খেতে দারুণ মজা লাগছে। ঝালের কারণে রাজা ঢক ঢক করে বারবার পানি খাচ্ছেন।
এই বউখুদার কাছে কোথায় লাগে রাজবাড়ীর পোলাও, কোর্মা, কালিয়া? অবশেষে পেট ভরে বউখুদা খেয়ে রাজা খুশী হয়ে একটা প্রকান্ড ঢেঁকুর তুললেন। ঐ ঢেঁকুরের আওয়াজের ঠ্যালায় সেদিন রাজবাড়ীর জানালাগুলো খট্ খট্ করে কেঁপে উঠেছিল। লোকে ভাবছিল, হঠাৎ ভুমিকম্প নাকি?
“বউখুদের গল্প হলো শেষ
আহা বেশ বেশ বেশ।”
এপিলগ : ছেলেবেলা বাবা অনেক মজার গল্প বলতেন। আমাদের হাসাতেন। 'চালমনির পুত্র' ছড়াটা তার কাছ থেকে শোনা, সেখান থেকেই মুখস্ত এবং সে থেকেই এই গল্পটার সূত্রপাত। বিক্রমপুরের সন্তান হিসেবে, ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি, বিক্রমপুরের মানুষদের দাবি 'বউখুদা' (খুদের বৌআ), তাদের আবিষ্কার। এ কথাটা পাঠকদের না বললেই নয়।
http://www.alokrekha.com
http://www.alokrekha.com
বদরুদ্দোজা চৌধুরী'র "রাজা খাবেন বউখুদা” গল্প বেশ মজাদার ও ইতিহাসের প্রমান পাওয়া যায়। খুব ভালো লাগলো পড়ে। আলোকরেখা ও লেখককে শুভ কামনা।
ReplyDeleteএক সময়ের "আমলকি ডাক্তার" এর লিখা "রাজা খাবেন বউ খুদা" পড়তে গিয়ে কিছুতেই ধাঁধাঁটা ধরতে পারছিলাম না ! পড়া শেষে কাল সারারাত ভেবে ভেবে এখন মনে হচ্ছে যে সবসময়ের লাজুক এবং নিভৃত্ত্বে কাজ করা মানুষটি তাঁর এই কল্পগল্পে কোরোনা কালে পাওয়া শিক্ষাটার কথা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন ! পোলাও-কোর্মা আর আড়ম্বর আমাদের কাম্য হলেও প্রকৃত সুখ আর স্বাস্থ্য-রক্ষায় যে কালিজিরার ভর্তা, পটল খোসার ভর্তা, মূলা বেলে মাছের ভর্তা, মরিচ বাটা, তেঁতুলের ভর্তা এসব দিয়ে গরম গরম খুদের পোলাওখেয়ে পরম তৃপ্তিতে জীবন অতিবাহিত করা সম্ভব - এই আভাসটুকু দেয়াই সম্ভবত এই ধাঁধাঁ পরিবেশনার পেছনের কারণ!
ReplyDeleteআপনাকে আরেকবার সশ্রদ্ধ সালাম !