আলোকের এই ঝর্নাধারায় ধুইয়ে দাও -আপনাকে এই লুকিয়ে-রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও-যে জন আমার মাঝে জড়িয়ে আছে ঘুমের জালে..আজ এই সকালে ধীরে ধীরে তার কপালে..এই অরুণ আলোর সোনার-কাঠি ছুঁইয়ে দাও..আমার পরান-বীণায় ঘুমিয়ে আছে অমৃতগান-তার নাইকো বাণী নাইকো ছন্দ নাইকো তান..তারে আনন্দের এই জাগরণী ছুঁইয়ে দাও চরিত্রান্তর ~ alokrekha আলোক রেখা
1) অতি দ্রুত বুঝতে চেষ্টা করো না, কারণ তাতে অনেক ভুল থেকে যায় -এডওয়ার্ড হল । 2) অবসর জীবন এবং অলসতাময় জীবন দুটো পৃথক জিনিস – বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন । 3) অভাব অভিযোগ এমন একটি সমস্যা যা অন্যের কাছে না বলাই ভালো – পিথাগোরাস । 4) আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও , আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেব- নেপোলিয়ন বোনাপার্ট । 5) আমরা জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহন করি না বলে আমাদের শিক্ষা পরিপূর্ণ হয় না – শিলার । 6) উপার্জনের চেয়ে বিতরণের মাঝেই বেশী সুখ নিহিত – ষ্টিনা। 7) একজন ঘুমন্ত ব্যাক্তি আরেকজন ঘুমন্ত ব্যাক্তি কে জাগ্রত করতে পারে না- শেখ সাদী । 8) একজন দরিদ্র লোক যত বেশী নিশ্চিত , একজন রাজা তত বেশী উদ্বিগ্ন – জন মেরিটন। 9) একজন মহান ব্যাক্তির মতত্ব বোঝা যায় ছোট ব্যাক্তিদের সাথে তার ব্যবহার দেখে – কার্লাইন । 10) একজন মহিলা সুন্দর হওয়ার চেয়ে চরিত্রবান হওয়া বেশী প্রয়োজন – লং ফেলো। 11) কাজকে ভালবাসলে কাজের মধ্যে আনন্দ পাওয়া যায় – আলফ্রেড মার্শা
  • Pages

    লেখনীর সূত্রপাত শুরু এখান থেকে

    চরিত্রান্তর

     চরিত্রান্তরজয়ন্ত সেন

    তখনো ত্রিশার প্রানটা বেরইনি, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে মাথার পেছন থেকে রক্ত গড়িয়ে মাটিতে মিশছে ত্রিশার হাত দুটো দু-পাশে ছড়িয়ে মুখ দিয়ে অস্ফুটে গোগানির শ্বব্দ বেরোচ্ছে, অসহ্য যন্ত্রনায় শরীরটা থর-থর করে কাঁপছে ছল্ছলে দুটো চোখ কালচে নীল তারা মাখা আকাশের দিকে তাকিয়ে, কিন্তু কিছু নজরে আসছে না ওর
    শুধু কানে শুনতে পাচ্ছে একটা আট বছরের ফ্রক পরা মেয়েরমা মাকরা আর্তনাদ ফাকা ঘরে সেই আর্তনাদ সারা ঘরময় ঘুরে বেড়ায়, হয়তো আজও সেই বাচ্চা মেয়েটার মা সিড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে, রক্তার্ত তার শরীরও তার মেয়ে সেই ছোট্ট-বেলার ত্রিশা ডাকছে কখন থেকে সেই মা আর সাড়া দেয়নি
    ত্রিশার মা মারা যাওয়ার কয়েকমাসের মধ্যেই বাড়িতে ত্রিশার নতুন মা এলো আর এক বছরের মাথায় নতুন মায়ের কোলে ত্রিশার ভাই
    সময় বয়ে যায় সময়ের মতোই সময়ের স্বভাব তাই পরিবর্তন, সময়ের ওটাই গড়িমা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয় সবকিছুরই বয়স, চরিত্র, বিজ্ঞান বয়স বেড়ে ফ্রক ছেড়ে ত্রিশা তখন সালোয়ার কামিজে কিন্তু সেই বাড়তি বয়সের অভিজ্ঞতা শুধু তার মনের বিতিস্নাই বাড়িয়েছে নতুন মা কোনদিনই তাকে স্কুলের জন্য টিফিন বাক্স ব্যাগে ভরে দিতো না, চুলে ফিতে বেঁধে দিতো না স্কুল শেষে বাড়ি ফেরত মেয়েকে খাবার বার করে দিতো না কখনও মন অস্থির হলে বুকের কাছে টেনে নিতো না
    দিনের পর দিন ত্রিশা কখনো বুকে বালিশ চেপে, কখনো বাথরুমের জলের শব্দের আড়ালে নালিশ জমিয়ে এসেছে সামান্য স্নেহ ভালবাসা, যেসব স্কুলের পাড়ার বাকি মেয়েদেরকে পেয়ে আসতে দেখেছে সেসব থেকে সেই কেনো বঞ্চিত রইলো ভাইয়েরও তো সব আবদার পুরন হয়।
    ত্রিশা বুঝেছে, সবাই নিজের কথাই চিন্তা করে পিসি ত্রিশাকে মাঝেমধ্যে ঘুরতে নিয়ে যায়, কখনো নন্দন কখনো স্বভূমি কেন ? অন্যান্য পুরুষদের সাথে সময় কাটানোর জন্য ত্রিশা তো শুধুমাত্র অজুহাত মাত্র

    সুতো-সেলাইয়ের কারবারকেই সাধারনত হুঁশিয়ারীর ব্যবসা বলা হয়ে থাকে। এক সময়ে বেশ ভালো রমরমা ছিল। তা সে কারবারে এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। প্রচুর আধুনিকতা চলে এসেছে। বন্ধ হয়েছে প্রচুর কারখানাও। ত্রিশার বাবার কারখানাটাও খুব একটা চলে না। ধার-বাকি অনেক হয়েগেছে। আর্থিক সংশয় বেশ ভালো মতো প্রভাব ফেলেছে তাদের সংসারে। ত্রিশাকে এসব কথা না জানালেও ত্রিশা বোঝে বউয়ের কথা শুনে বাবা মারধোর করে মেয়েকে, যাতে রাতে বউয়ের পাশে শুতে পারে, কোনো মহাজন টাকার তাগাদা করতে আসলে বাড়তি বয়সি মেয়েকে সামনে এগিয়ে দিয়ে বলেবাবা বাড়ি নেই বলে দে আর মহাজন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে, গাল টেপার বাহানায় বুকের কাছটা ছুঁয়েঅমুক এসেছিল বলেদিসবলে ফিরে যায় ত্রিশা সবই বোঝে কাকিমা দেখাশোনা করে, যতটুকু আদর-যত্ন পায়, কাকিমার কাছেই। নিশ্চই তারও কোন স্বার্থ আছে সবাই নিজের ভালো লাগাটা বুঝে নেয় না পাওয়া গুলোকে নানা উপায়ে হাসিল করে নয়তো বিকল্প কোন পথ বেছে নেয় সুচিস্মিতা, ত্রিশার বাল্যবন্ধু ওর বাবা নেই , মদের নেশা গিলে খেয়েছে বড় একটা পুরোনো ফাটল ধরা বাড়িতে শুধু দুইজন মানুষ্ থাকে মা আর মেয়ে সংসারে অভাব তাই হয়তো সত্তর দশকের হিপিনীদের মতো সুচিস্মিতা একাধিক পুরুষদের সাথে সম্পর্ক রেখে আর শরীরী ছোঁয়াছুয়ির বিনিময়ে নতুন নতুন দামী দামী মেকাপ কিট থেকে টপ, জীনস, ব্যাগ, জুতো, লেটেস্ট মোবাইল হাতিয়ে গটগট করে পারি দেয় শপিং-মলে ডিনার সাড়ে বড় বড় রেস্টুরেন্টে সেখানেই তার সুখ, তার সবকিছু পাওয়া
    কথায় আছে, লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু তাহলে কি যারা লোভ করে না তাদের মৃত্যু নেই ! লোভতো সবারই আছে কেউ ভালো ভালো খাবো, কেউ ভালো ভালো পোশাক পরবো, কেউ আবার দূর পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে যাওয়ার অথবা নীল সাগরের তলার শান্ত দুনিয়ার রহস্যভেদের লোভ পোষে আসলে লোভ না হলে সফল হওয়া যায় না সফল মানুষকে কেউ ঘাটাতে চায় না তাকে সবাই সমিহ করে, সে কি পথে সফল সেসব দেকতে যায় না কেউ আর
    ডানলপের কোন এক হোটেলে এক সন্ধ্যেবেলায় পুলিশী হানায় ত্রিশার পিসি ধরা পরেছিলো পরপুরুষের সাথে নগ্ন অবস্থায় সাড়া পাড়ায় ছি ছি পরে গেলো নোংরা, চরিত্রহীন মহিলা আরো কতো কি অপমান সহ্য না করতে পেরে স্বামী গলায় দড়ি দেয় কারোর কিছু এলোগেলনা কয়েকদিন বাদ সেই মহিলাই এক রাজনৈতিক দলের নেত্রী হয়ে চেয়ারে বসলো যখন সব যেনো হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল তার পায়ের নীচে যারা যারা একসময় ছ্যা-ছ্যা করেছিল তারাই আজ আসুন ম্যাডাম বসুন ম্যাডাম করতে হাপায় না জীবনে সফল ব্যাক্তি সূর্যের মতো, সবাই প্রনাম জানায়

    মরণের আগে নাকি চোখের সামনে দিয়ে জীবনটা একবার ঘুরে যায়, ভালো-খারাপ, দোষ-গুণ মুহুর্তে নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন-জবাবদিহীর খেলা হয়ে যায় আমারও একবার মরণ এসেছিলো, আমিও দেখেছি ফ্ল্যাস-ব্যাকে আমার অতীতটাকে
    অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে, ত্রিশা তখন দুইহাত সামনের দিকে তুলে বৃষ্টি ধরায় ব্যস্ত সারা শরীর ভিজে, উজ্জল রং, বড় বড় চোখ, মুক্তর মত হাসি, উন্নত স্তন, যৌবনের ধারায় তখন পরিপূর্ণ আকাশে মেঘ গর্জে উঠলো প্রচন্ড জোরে ত্রিশা ভয়ে আমায় জড়িয়ে ধরলো বুকের মধ্যে মাথা রেখে সেঁধিয়ে গেলো আমি আরো আঁকড়ে ধরলাম, কন্ঠহার ছাড়া ত্রিশার সাড়া শরীর কতো নরম ঠোঁটে ঠোঁট রেখে আশ্বস্ত করলামভয় পেও না, আমি আছি তোমার সাথে, তোমার পাশে, সবসময়, সারাজীবন
    আমার বাবা একদিন বাড়ি থেকে বেরোলো, আর ফিরলো না মা ছোটো বোনটাকে আমার কাছে রেখে সেলাইয়ের কারখানায় কাজ করতে যেত বাস্তবটাকে সেইসময় থেকেই বাস্তবের মত করেই দেকতে শিখে গেছিলাম বাস্তবটা আসলে খোলা নগ্ন বইয়ের খোলাম্কুচির মত উড়তে থাকা পাতা যে যতোটা পার নিয়ে নাও আর চিনতে শিখেছিলাম ছোটবেলায় শোনা রূপকথার গল্প গুলোর মাঝে বাস্তবের তফাৎ রূপকথায় খিদিরপুর, সল্টলেক, সি.আর.এভিনিউ পায়ে হাটা পথ নেই রাস্তার ধারে সস্তার হোটেলে যখন কোনো কর্মচারী বেলাশেষে বেঁচে যাওয়া ভাত আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিতে যায় তাকে কেউ বাধা দিয়ে বলে না, ‘ফেলেই যখন দিচ্ছো, আমায় দিয়ে দাও, বাড়িতে দুটো বাচ্চা আছে
    সময় বদ্লে যায় তার নিজের মতই, আর সময়ের সাথে বদ্লে যায় সবকিছুই সময় কখনো আমাদের সাথে চলে, কখনো বিপরীতে ভালো থেকে খারাপ, খারাপ থেকে ভালো হওয়া, এসবই সময়চক্রের এক একটা অধ্যায় একটা অন্ধকার ঘরে তিনটে প্রানের সংসারের দিনআনা দিন খাওয়া জীবনের কঠীন বাস্তবের পাশে বাস্তবের সুন্দর রূপও আছে তফাৎ থাকলেও কখনো রূপকথার গল্পে গিয়ে আবার মেলে
    যেমন, ত্রিশাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম উচ্ছাস ভরা সুঠাম শরীর বেয়াদপ চুলগুলো কপালের ওপর থেকে বারেবারে সরিয়ে নেয় সেই মুক্তোর মত হাসি, যে হাসির জন্য জীবনের সবকিছু উজাড় করে দিতে পারতাম যে হাসিতে দীর্ঘদিনের জমে থাকা সব রাগ-অভিমান, সব ক্লান্তি মুছে যেত চায়ের দোকানের বেঞ্চের আড্ডা থেকে মনটা দৌড় দিল মেয়েটির পেছনে, সাথে নিয়ে গেল সমস্ত পাগলামীগুলো পরে জেনেছিলাম মেয়েটির নাম ত্রিশা। তারপর ত্রিশা আমার হাত ধরে নিয়ে চললো পাহাড়ের কোন চুড়ায়, যেখানে এক সুন্দর বাগান আছে সে বিশাল বাগান, নানা রঙের ফুলে সাজানো কি মোলায়েম তার অনুভব বাগানের ঠিক মাঝখানে একটা ছোট্ট ঘর, ওটা আমাদের ঘর বাগানটাও আমাদেরই হাতে সাজানো


    জীবনের প্রতি নালিশ ত্রিশার পেছন ছাড়ে না অল্প বয়সে ভালো থাকার বিকল্প পথের পরিকল্পনায় রাত জাগা, বিয়ের পর অর্নবের সাথে অতৃপ্ত শরীর নিয়ে অসহ্যকর রাত জাগা প্রতিবার শারীরিক সম্পর্কের সময় চূড়ান্ত ক্লাই্-ম্যাক্সের আগেই অর্নবের ভেঙ্গে পড়ায় ত্রিশাও ভেঙ্গে পড়ছিল ভেতর ভেতর কিন্তু ত্রিশা কোনদিন অর্নবকে বুঝতে দেয়নি , অনেক কিছু হারাবার ভয় ছিল
    খুব ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছিল ত্রিশা অর্নবের বেটে-খাটো, খুবই সাধারণ মতো শান্ত-স্বভাবের অর্নব গুছিয়ে কথা বলে তবু কথাবার্তার ভাজে বেশ দাপট আছে অহঙ্কারী দাপট হবে নাই কেন ! বড়লোক বাড়ির ছেলে, যাকে বলে সোনার চামচ নিয়ে জন্ম মেধাবী ছাত্র, পড়াশোনাও বেশ দূর অব্দি পারিবারিক ব্যাবসায় মাথা ঢুকিয়ে আরো প্রতিপত্তি বেড়েছে জীবনে যেটা চেয়েছে পেয়েছে কোন এক অনুষ্ঠানে ত্রিশাকে দেখে প্রেমে পড়ে যায় উজাড় করে ভালবাসার সাথে একটা সিন্দুকের চাবিও ধরিয়ে দিল ত্রিশার হাতে সেই সিন্দুক, যার মধ্যে রয়েছে প্রচুর টাকা-পয়সা, গয়না-গাটি, গাড়ি বাড়ি, উন্নত ভবিষ্যৎ যেখানে সব সমস্যার সমাধান কেনা যায় অনায়াসে সেখানে আর সেই পুরনো রং-দেয়াল চটা চার দেওয়ালের মধ্যের একঘেয়ে জীবন নেই। ত্রিশা সেসব হারাতে চাইছিল না কোনভাবেই
    বিকল্প রাস্তা খুঁজে পেয়েছিল

    রাত তখন দুটো হবে। অনেক্ষন ধরে ল্যাপটপে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক- ত্রিশা জয়ন্তর প্রোফাইলটা ঘেঁটে চলেছে। সেদিন সন্ধ্যেবেলায় একটা গেট-টুগেদার অনুষ্ঠান হয়েছিল সোমাদির বাড়িতে। সোমাদি ত্রিশার সৎ-ভাইকে প্রইভেট টিউশন দিত। ত্রিশাদের বাড়িতে পড়াতে আসত। এটা সেটা কথায় কথায় সোমাদির সাথে ত্রিশার ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। দুজনেরই বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও এখনো যোগাযোগ রয়ে গেছে। একে অপরকে ব্যক্তিগত অনেক কথাই জানায়। রান্না-ঘরে সোমাদিকে সাহায্য করতে গিয়ে ত্রিশা গল্প জুড়ে দেয়। কথায় কথায় সোমা জানায় ত্রিশার খুড়তুতো বোন অনামিকাকে একদিন সোমা রাস্তায় দেখেছে। যদিও বা এই কথাতে অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা ছিল না। ত্রিশার কাছে চাবুক মারার মত কথা যেটা তার পরে সোমা বলেছিল। অনামিকাকে দেখেছিলো জয়ন্তর সাথে। লম্বা- ছিপছিপে রোগা, কোনো এক রেস্টুরেন্টে কাজ করতো তখন, যখন জয়ন্ত ত্রিশার প্রেমিক ছিল। মনে মনেপাগল ছেলেবলে হেসে ওঠে ত্রিশা। মনে করে সেই ত্রিশাকে একটিবার দেখার জন্যে ঘন্টার পর ঘন্টা ত্রিশার বাড়ির জানলার উল্টোদিকে জয়ন্তর দাঁড়িয়ে থাকার কথা। সেই রাস্তায় কোনো এক ছেলের ত্রিশার প্রতি টিটকিরির পর জয়ন্তর সাথে তার হাতা-হাতির কথা, ছাদের ঘরে ত্রিশার মাংসপেশী তে উষ্ণ-আদরের কথা। কিন্তু ভালবাসা দিয়ে ভবিষ্যৎ হয়না বলেই মনে করে ত্রিশা। তবুও কখনো কখনো জয়ন্তর কথা ত্রিশার মনে পড়লেও পড়ে, একান্তে। আশ্চর্য, অনেকটা সময় কেটে গেছে, অনেক কিছুই পাল্টেছে ত্রিশার জীবনে, সেসব তো অনেক আগেই ফেলে এসেছে, তবুও কেন যে সোমাদির মুখে জয়ন্তর নামটা শুনে এরকম হলো ! যেন বস্তা ভরা কৌতুহলের জন্ম।জয়ন্ত এখন কি করে ? কেমন আছে ? তারও জীবনে নিশ্চই অনেক পরিবর্তন এসেছে, তার কি কোনো প্রেমিকা আছে ? ত্রিশার কথা কি তার মনে পড়ে ? ইত্যাদি

    প্রোফাইল ঘেঁটে সেরকম কিছুই বুঝতে পারা যায়নি জয়ন্তর বর্তমান জীবন সম্পর্কে। রয়েছে কেত মেরে তোলা গোটা কয়েক ছবি আর প্রচুর কবিতা। ওগুলো নিশ্চই জয়ন্তরই লেখা। আগেও লিখতো। কয়েকটা পড়লো , ব্যার্থ প্রেম সংক্রান্ত। এই কবিতাটা বেশ লাগলো

    শরীরের অন্তর সৈকতে, দূরে এক জাহাজ দাঁড়িয়ে,

    তোর চোখের কবিতায়, কাছে টানার হাত বাড়িয়ে,

    অপেক্ষা, শুধু অপেক্ষা

    আবার ত্রিশার মনে প্রশ্ন এলো, ” এখনো কি ত্রিশাকে মনে মনে পুষে রেখেছে ?”

    হাউ আর ইউ ?”

    অনেক্ষণ ভেবে ভেবে একটা মেসেজ করেই দিলো। রেপ্লাইও পেলো সাথে সাথে।আয়াম গুড, ইউ ? “


    জয়ন্ত, লম্বা, ছিপছিপে রোগা, একমাথা চুল, পনিটেল করা, তামার মত গায়ের রং, থুতনির নীচে ছাগলের মত দাড়ি, ঘাড়ে গর্দানে উল্কি আঁকা ভীষন রকম বেপরোয়া নাও হতে পারে, কিন্তু সেটাই দেখিয়ে আসতে সফল ভয় নেই, ঘেন্যা নেই কলকাতার এক বারে সন্ধ্যেবেলায় গিটার বাজায় তারপর নেশায় বুঁদ হয়ে পিশাচের মত ঘুরে বেড়ায় কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় দিনেরবেলা কোনো একটা কাজ করতো, সন্ধ্যেবেলা আরেকটা, বাকি সময়টা হোর্ডিং-বানানোর কাজ। সপ্তাহ শেষের দিনগুলোতে ইভেন্ট এর কাজ। তারও একটা স্বপ্ন ছিলো। ভেবেছিল সুর-সঙ্গীত নিয়ে জীবন কাটবে। পিঠে গিটার বেঁধে দেশ-বিদেশ ঘুরবে। তারে ঝংকার তুলে উপচে ওঠা ভীরের তালে গান গাইবে। তারপর লাফিয়ে পড়বে সেই ভীরের মাঝে। অনুভব করবে লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের হাত তাকে ছোবার জন্য পাগল হচ্ছে। কি রোমাঞ্চকর হতে পারে জীবনটা। তারপর নিজের ওপরেই হাসে। আর্থিক অনটনে পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি আর। একটা বার- ওয়েটার হিসেবে কাজ পেয়েছিল।

    একদিন ক্রিসমাসের মত বড় ওকেশনের দিনে, যে সময়ে বার গুলোতে বিশাল আকারে ভীর ঠেলা হয়। বিশাল বিজনেসের সময়। এরকম সময়ে বারের গিটারিস্ট-এর বাইক দুর্ঘটনা হয়। বারের আকর্ষন কমে যাবে, বিজনেসের এত বড় সুযোগে পড়তে বারের মালিকের মাথায় হাত। কেউ যেন জয়ন্ত আর তার গিটারের সম্পর্কের কথা মালিকের কানে তুলেছিল। এখন আর সে অবস্থা নেই জয়ন্তর। অনেক ভালো হয়ে গেছে।এক সময়প্রেম, “ভালবাসানামক বিষয় গুলো জয়ন্তর খুব প্রিয় ছিল। এখন তার অপমান হতে খুব ভালো লাগে। বলে, অপমানের জবাবে বিপরীত ব্যক্তিকে বাঁশ দিলে মনের মধ্যে কেমন নায়ক নায়ক ভাব গর্জে আসে।

    আমার সাথে দেখা হয়েছিল প্রথম সেদিন। ফেব্রূয়ারী মাসের মাঝামাঝি দিন, শহর জুড়ে প্রেমদিবসের তোলপাড় চলছে একটা ল্যাম্প-পোস্টের নীচে আমিও আমার প্রেমিকার অপেক্ষায় দাড়িয়ে ছিলাম একটা প্রাইভেট-গাড়ি সামনে এসে দাড়ালো উইন্ড-গ্লাসটা ধীরে ধীরে নেমে আসে, আর ভেতর থেকে আমার প্রেমিকার মুখটা বেরিয়ে আসে একদলা থুতু আমার মুখের ওপর ছুড়ে আবার এগিয়ে যায়
    সেই যে বাগিচা, পাহাড়ের ওপর সুন্দর করে সাজানো পুড়ে গেল মুহুর্তে আরো কিছুটা সময় নিয়ে বুঝলাম পা পিছলে গেছে অনেক আগেই, আর আমি খাদে পড়ছি অন্ধকার চারিদিক, আর আমি পড়ছি নিজেকে ধরার জন্য হাত-পা ছুড়ছি, কিছু পাচ্ছি না, উল্টে কেটে যাচ্ছে, ছড়ে যাচ্ছে অসহ্য যন্ত্রনা করছে দুটো হাটুর মাঝে মাথা ঢুকিয়ে কেঁদে কাটিয়েছি কতদিন হিসেব নেই প্রশ্ন, ‘যদিতাড়া করে বেড়াত দিনরাত কখন যেন চোখ বুঝে এসেছে আমার শুধু মনে আছে মাথার কাছে এক ছায়ামূর্তি দাড়িয়ে, জয়ন্ত আর কিছু মনে নেই

    উত্তর কলকাতার পৈত্রিক পুরোন তিনতলা বাড়িতে একাই থাকে অনেকগুলো ঘরে তালা লাগানো। খোলা হয়না বহুদিন ধরে। একসময়ে মা-বোনকে নিয়ে একটা কোণের ঘরে থাকতো। বাকি বাড়ির সবটাই ভোগ করতো জয়ন্তর কাকা। ওই একখানি ঘর, আলো নেই, বাতাস আসে না, দুপুরের রোদ-আলো একখানি জানালা দিয়ে ঢুকতো যতটুকু। বহুবছর এভাবেই তিনটে প্রানের জীবন কেটেছে। তখন সবচেয়ে খুশির দিন হতো পাড়ার কালী পুজোর সময়। পাড়া সাজানো হতো, খুব ধুম করে, হরেক রঙের আলো লাগানো হতো, সারারাত সে আলো ঘরে ঢুকতে পারত।

    সেসব অনেক বছর আগের কথা যদিও, জয়ন্তর কাকিমা সংসার ছেড়ে চলে গেছিলো অন্য আরেক লোকের হাত ধরে। কাকা যতই বজ্জাত লোক হোক না কেনো , স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন। ঘটনাটা সহ্য করতে পারেনি, মুষড়ে পড়েছিলেন। এক বছরের মাথায় ভারী কোনো অসুখে মারাও গেছিলো। তাদের একমাত্র ছেলেও বাড়ি ছেড়ে মামারবাড়ি চলে গেল। একমাত্র বোন পড়ালেখা শিখে চাকরি করে দিল্লীতে মাকেও নিয়ে গেছে


    জানলার বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে ত্রিশা চোখ খুলে দেখে, জানলার একপারে নগ্ন অবস্থায় দাড়িয়ে জয়ন্ত সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে বিছানা ছেড়ে ত্রিশা উঠে যায় জয়ন্তকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করেকি ভাবছো ?”

    কিছু না

    তুমি আর অনামিকার সাথে কথা বোলো না কিন্তু। ওকে এড়িয়ে চলো।

    কেনো ?”

    না, আমি চাই না।

    আর আমি !! আমি কি চাই সে কথা কোনদিন ভেবেছো ! “

    কথাগুলো বলতে বলতে ত্রিশার কপালে সিঁথির কাছটা আলতো করে আঙ্গুল বোলাতে থাকে। ত্রিশা জয়ন্তর বুকে আবার মাথা রাখে। বলেকেনো এসব ভাবছ ? এখনতো আমি শুধু তোমার। তোমার আমার সম্পর্কের মধ্যে কি কোনো স্ট্যাম্প লাগাতেই হবে ? নাকি দরকার আছে ? “

    সেই যে শোস্যাল নেটওয়ার্ক সাইটে- জয়ন্তর সাথে ত্রিশার কথা শুরু হয়েছিল, ধীরে ধীরে ফোন কল, তারপর রোজকার চলার পথে টুকটাক দেখা করা থেকে আজ সেটা বিছানা অব্দি পৌঁছে গেছে।পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে একটু নতুন রং মাখিয়ে জয়ন্তকে সযত্নে পরিবেশন করতে খুবই সাধারনভাবে অনায়াসে জয়ন্ত ত্রিশার বশে চলে আসে।

    জয়ন্ত ছন্দ কাটেশরীরটাই যা বেঁচে আছে, সেটাই শুধু দেখেছিস ; ছেঁড়া-কাটা করবি আর কি! বাকিটাই বা আর কি রেখেছিস ?” ত্রিশা আবার জয়ন্তর ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। বলেচুপ কর

    অনামিকা বাড়ি ঢুকতেই অশান্তি শুরু হয়ে যায়। কি না আজেবাজে ছেলেদের সাথে মেলামেশা করে, বাউন্ডুলেদের মতো রাস্তায় নাকি টো-টো করে ঘুরে বেড়ায়, বেলাল্লাপানার একশেষ , এসব কি কোনো ভদ্র বাড়ির মেয়েরা করে নাকি! শিক্ষা-দীক্ষা নেই, কালচার নেই, অনামিকার জ্যেঠা চিত্কার করছে। সবার থেকে বড় বলে অনামিকার জ্যেঠারিই হুকুম চলে এখনো বাড়িতে। অনামিকার অসয্য লাগছে, কিসের শিক্ষা-দীক্ষা, কালচারের কথা বলছে জেঠু ? ওনার পরিবারে ওনার বউ তার ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে, নিয়ে গেছে ঘরের আসবাবপত্র পর্যন্ত, ওনার মেয়ে যে কি কিত্তিটাই না করে বেড়াচ্ছে।অনামিকা বাড়ি ঢুকতেই অশান্তি শুরু হয়ে যায়। কি না আজেবাজে ছেলেদের সাথে মেলামেশা করে, বাউন্ডুলেদের মতো রাস্তায় নাকি টো-টো করে ঘুরে বেড়ায়, বেলাল্লাপানার একশেষ , এসব কি কোনো ভদ্র বাড়ির মেয়েরা করে নাকি! শিক্ষা-দীক্ষা নেই, কালচার নেই, অনামিকার জ্যেঠা চিত্কার করছে। এখনো একটা ঘটনার কথা কাউকে জানায়নি অনামিকা। ত্রিশাদির প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর দিন, অর্নবদাদের বাড়িতে পার্টি ছিল, পরিবার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে। অনামিকা খুব বিরক্ত অনুভব করছিল সেখানে। তার বয়সী কেউ সেরম নেই যেন, সবাইকে চেনেও না, তাছাড়া অর্নবদাদের বড় বড় ব্যাপার। মুখ বিকৃত করে সবাই যেন নিজেদের আপন প্রসংসায় পঞ্চমুখ। দামী দামী আর নাম করা ব্র্যান্ড-এর শো-অফ। অনামিকার বাবা সাধারন খুব সল্প মাইনেতে দারোয়ানের একটা কাজ করে। কোনরকমে তাদের সংসার চলে। মা বাবা অনেক কষ্ট করে অনামিকার পড়াশোনার খরচ চালায়। তার শো-অফ করার মত এখানে কিই বা থাকতে পারে ? এককোণে অনেক্ষণ কাটাবার পর অর্নবদার বাড়ির পেছনের দিকের স্টোর-রুমে চলে যায়। সেই ঘরটার কথা অনামিকা জানত। এখানে যতসব বাজেয়াপ্ত করা আসবাবপত্র রাখা হয়। কেউ এখানে আসে না। ঘরের বাইরের দিকে মুখ বাড়িয়ে অনামিকা সিগারেট টানতে থাকে। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে এখন অনামিকা কলেজে। অনেক বন্ধুদেরকেই খেতে দেখেছে, কৌতুহলে নিজেও টেনেছে বহুবার, সেই বন্ধুরাই বলেছেখুব টেনস লাগলে বা বিরক্ত লাগলে টেনে নিবি , দেখবি রিলাক্স লাগবে।হটাত কেমন যেন আওয়াজ পেল, কেউ কথা বলছে, লুকিয়ে শোনবার চেষ্টা করল, বুঝলোকেনয়কারাযেন কথা বলছে। কথা থামতেই শীত্কার-এর শব্দ আসতে থাকে, একটা মেয়ের। তারই সাথে কাঠের কিছুর সাথে দেওয়ালে বারবার ঠোকা-ঠুকির শব্দ। শব্দটা আরো তীব্র হতে থাকে। খুব কৌতুহলের সাথে আর সতর্ক ভাবে নিজেকে আড়াল করে অনামিকা তাদেরকে দেখার চেষ্টা করে। শাড়ি, ব্লাউজ মাটিতে পরে, তার জেঠতুত দিদি যার কিনা আজ বিবাহ-বার্ষিকী, সে অর্ধ-নগ্ন অবস্থায় দু-পা ছড়িয়ে একটা পুরনো ড্রেসিং টবিলের ওপর পরে আছে, আর তার পাশে সুখ দিতে ব্যস্ত জয়ন্তদা।

    অনামিকা উত্তর দেয়তুমি নিজের চিন্তাটাই ভালো মত কর জেঠু , আমার ভালো খারাপ আমি বুঝে নিতে জানি।

    কথাটা শুনে অনামিকার জ্যেঠার গলার স্বর আরো তীব্র হয়। এই মারে তো সেই মারে করে ছুটে আসছিল। সজোরে একটা চর মেরে অনামিকার মা অনামিকাকে ঘরে নিয়ে চলে যায়।

    রাতে খাওয়ার সময় অনামিকার মা বলেকেন যে তুই বড়দের সাথে মুখ লাগাস !”

    মাকে ধমক দিয়ে ওঠে অনামিকা, “চুপ করো তো ! জেঠুর নিজের অবস্থা দেখেছ, ঘরের খাচ্ছে বনের মোষ তাড়াচ্ছে। ওই যে অর্নবদার থেকে অতগুলো টাকা নিল, কারখানাটা কি চালাতে পারলো ! আর ত্রিশদি ! এত বড় ঘরে যে বিয়ে হোলো, তুমি তো ওকে মানুষ করলে বড় করলে, কই তোমার প্রতি তো কোনো দায়িত্ব পালন করেনি, দিদি কি পারত না ?”

    চুপ কর। নাই বা করুক। আমি আশাও রাখি না। কে করেছে বা করেনি সে নিয়ে চিন্তা করে কি লাভ বল। তুই আমার মেয়ে, তুই বড় হবি, তুই আমার নাম করবি।শান্তভাবে অনামিকার মা অনামিকাকে বোঝায়।

    কিছুক্ষন চুপ থাকার পর জিজ্ঞাসা করেতুই কি জয়ন্তর সাথে মেলামেশা করিস ?”

    অনামিকা বুঝতে পারে, গতকাল ত্রিশা বাড়ি এসেছিল, মাঝেমধ্যেই আসে। ত্রিশাদির শ্বশুর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি বেশি দুরও নয়। নিশ্চই বলেছে জয়ন্ত অনামিকার কথা।

    ত্রিশাদির অনেক গুলো প্রেমিকের মধ্যে জয়ন্তদাও একজন ছিল, বিয়ের আগে। অনেকদিন চলেও ছিল ওদের সম্পর্কটা। অনেকবার দিদির মুখ থেকে জয়ন্তদার গল্পও শুনেছে। বাড়ির পেছনের অন্ধকার গলিতে মুখে মুখ লাগিয়ে চুমু খেতেও দেখেছে বহুবার। তখন অনামিকার কতই বা বয়স হবে, দিদিকে অনেকবার জিজ্ঞাসাও করেছে যে তারা কি করছিলো। দিদি বলতোবুঝবি না এখন কিছু, তুই আরো বড় হবি যখন তখন বুঝবি কি করি কেনো করি।দিদি ঠিকই বলেছিলো।

    তারপর একদিন রাস্তায় খুব হই-হট্টগোলের আওয়াজে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে জয়ন্তদাকে ঘিরে তিন-চারজন লোক। তাদের একজনের হাতে শক্ত কাঠের বাটাম। তারপর সবাই মিলে ঝাপিয়ে পরলো জয়ন্তদার ওপরে।

    কিছুক্ষণবাদে আবার দেখতে পেলো, ছেঁড়া-রক্ত লাগা জমায় লেপ্টে আছে। তারা চ্যাং-দোলা করে কোথায় যেনো নিয়ে গেলো।

    একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে অনামিকার পা মুচকে গেছিল। সে কি ব্যাথা, পা ফেলা মুস্কিল, হাঁটা তো দুরের কথা। রিকশারও পয়সা নেই, বাড়ি ফিরবে কি করে ? এমন সময় জয়ন্তদা কোথা থেকে যেন উদয় হোলো।কি রে কি হয়েছে ?” খুব পরিচিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল। তারপর সেদিন অনামিকাকে বাড়ি পৌছে দেবার ব্যবস্থাও করে দিল।

    জয়ন্তদার সাথে তার পরে অনেকবার দেখা হয়েছে অনামিকার। প্রায় নিয়ম করেই। আজব ধরনের মানুষ। নেপালে ভূমিকম্প হোক, প্যারিস- আতঙ্ক, কিংবা বাংলার মেট্রো টিকিটের দাম বাড়ুক। জয়ন্তদার কোনো কিছু যেন আসে যায় না। খবরের কাগজ পড়ে না, নিউজ চ্যানেল দেখে না। কিন্তু মাঝেমধ্যে বাস্তব নিয়ে জ্ঞানের কথা বলে। সেসব কথা অনামিকার ভালো লাগে। একবার বলেছিলকুকুর তোমায় কামড়ালে কুকুরকেও কামড়ানোর দরকার নেই, কিন্তু তাকে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে ভাগানো খুবই দরকার।এখন যেন অনামিকার মনে হয় ঠিকই বলেছিল। দিদিটা খুব উত্পাত করছে তো, শুধু শুধু অনামিকার পেছনে লাগা।

    ত্রিশাদির বাড়িতে জয়ন্তদাকে ওরকম অশ্লীল অবস্থায় দেখার কথাটাও একবার বলেছিলো কথায় কথায়। জয়ন্ত শুধু হেঁয়ালি করে ছন্দ কেটেছিলমানুষ মেরে মানুষ হবে, এটাই আধুনিক নীতি ; প্রতিহিংসার গল্প গুলি একদিন দেবে ইতি।

    অনামিকা এখন জার্নালিজম নিয়ে পড়ছে। সেমিস্টার- এসায়ন্মেন্ট দিয়েছে একটা আর্টিকেল লিখতে হবে। সেটা যে কোনো বিষয়ের ওপর হতে পারে। ভাবনা চিন্তায় ছিলো অনামিকা। জয়ন্ত বিষয়টা বলে দিলস্ট্রিট ফাইটার

    কিন্তু এরা তারা নয় স্ট্রিট ফাইটার বলতে আমরা যাদের বুঝি। এরা টাকার বিনিময়ে রাস্তা-ঘাটে কোনো গুপ্ত জায়গায় একে অপরের সাথে মারামারি করে রক্ত বওয়ায় না। এরা তারা, যারা জীবন অর্জনের জন্য রক্ত জল করে ঘরে ফেরে।

    জয়ন্ত অনামিকাকে একটা ক্যামেরা-ওলা মোবাইলও দিয়েছে, প্রত্যক্ষ দর্শনের জন্য বাইকে করে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়েছে। অনামিকা বেশ কিছু ছবিও নিয়েছে। বড়বাজারে ঝাঁকা বোঝাই করা মুটে, দড়ির ওপর খেলা দেখানো বাচ্চা মেয়ে, ট্রাফিক পুলিশ, সারাক্ষন গাল খাওয়া বাস ড্রাইভার, শেয়ালদহ স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসা ভীড়, রাস্তা পার হতে ব্যাস্ত ভীড়, বাটি হাতে ভিখারী, পাগল, ছটা বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো একটা মা কুকুর।

    জয়ন্তদার ল্যাপটপ আর ডেটাকার্ড টা সাথেই নিয়ে এসেছিল। সেটাতেই কাজ করছিলো অনামিকা। সেটা দেখে তার মা তাকে বলেলোভ, অভিমান, হিংসা এসব বড় কম দামে আমাদের মধ্যে চলে আসে কিন্তু তার মূল্য বোঝাই করা এত সহজ নয়। সুচিস্মিতার কি হয়েছিল মনে রাখিস।

    সুচিস্মিতা, ত্রিশাদির বাল্য-বন্ধু। অভাবী সংসার থেকে বিখ্যাত অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন-এর গল্প। এক বিখ্যাত সফল অভিনেতা একটা রিয়ালিটি শোতে বলেছিলেনস্বপ্ন কি? যা চোখ বন্ধ করে ঘুমের মধ্যে দেখি ? না। স্বপ্ন সেটাই যার জন্য দু-চোখের ঘুম চলে যায়।

    কিন্তু কি মূল্যে ?

    সুচিস্মিতার ছোটবেলার সময় তাদের পাশের বাড়িতে একটা বাক্স দেখেছিল। সে বাক্সের ভেতরে একটা পৃথিবী আছে। সেখানে সুন্দর সুন্দর মানুষ থাকে। তারা কখনো গান গায়, কখনো নাচ করে। সুন্দর সুন্দর পোশাক পরে। কত সুন্দর জীবন তাদের। সুচিস্মিতার খব মন টানতো। বড় হতে বুঝতে পারে সেই বাক্সের ভেতরের পৃথিবীর রহস্যের কথা। সেখানে পৌঁছবার লালসা এতটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল যে নিজের সৌন্দর্য-যৌবন ব্যাবহারে ঠিক-বেঠিকের খেই হারিয়ে ফেলেছিল।

    সুচিস্মিতা আত্মহত্যা করেছিলো। তার কয়েকদিন আগে ইন্টারনেট- নীল্ দুনিয়ায় তার একটা অশ্লীল চলচিত্র দেখা গেছিলো। বিবেক যখন কড়া নাড়ে সেটা সহ্য করা নাকি সবচেয়ে বেশি দুস্কর। সুচিস্মিতারও তাই হয়েছিলো।

    জয়ন্তদা এত সাহায্য করছে কেনো ? এই প্রশ্নটা বহুবার মাথায় এসেছে অনামিকার। কিন্তু কোনদিন জিজ্ঞেস করা হয়নি, আর তার উত্তরও মেলেনি।


    কাঁচের একটা গ্লাসে খানিকটা হুইস্কি ঢেলে অর্নবকে বাড়িয়ে দেয় জয়ন্ত তারপর, অনেক্ষনের নিরবতা ভেঙ্গে জয়ন্ত বলেতুই যে একদিন আমার সাথে দেখা করতে আসবি, জানতাম অর্নব খুবই খুশি ছিলো সেদিন, ত্রিশা তাকে জানিয়েছে যে সে বাবা হতে চলেছে। কুরিয়ার থেকে একটা পার্সল এসছিলো অর্ণবের অফিসে অর্নবের নামে। একটা খামে শুধু একটা পেন-ড্রাইভ, একটা কাগজও ছিলো। তাতে টাইপিং করে লেখা আছেশুনলাম তুই বাবা হতে চলেছিস, কিন্তু এটাও জেনে রাখ বাচ্চাটার বাবা তুই নোস্।পেন-ড্রাইভটা ল্যাপটপে লাগিয়ে ওপেন করতে দেখে বেশ কিছু ত্রিশার ছবি। ত্রিশার বিয়ের থেকে শুরু করে ত্রিশার বাথরুমে তোলা নগ্ন সেলফি।কে পাঠিয়েছে ? কেনো পাঠিয়েছে ? আর কোথাও কিছু নেই। কুরিয়ার সার্ভার-এর কাগজটাতে যে এড্রেস তা দেওয়া আছে সেটা যে মিথ্যে সেটা যাচাই করে দেখে নিয়েছে। জমি যেন অর্নবকে আঁকড়ে ধরে রয়েছে। ধীরে ধীরে যেন কোথায় তলিয়ে যাছে অর্নব বুঝতে পারছে না।

    ত্রিশার অন্যরকম আচরণ অনেকবারই নজরে পড়েছিল, বিবাহ বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ওভাবে অতক্ষন ত্রিশাকে না খুঁজে পাওয়া সব যেনো তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

    ত্রিশা প্রায় বাড়ি থেকে কোনো না কোনো অঝুহাতে বেরিয়ে যেত, বেশিরভাগ দুপুরবেলা। অর্নব অফিস যাওয়ার নাম করে একবার ত্রিশার পিছু করেছিলো।

    কি চাইছ তুমি ? টাকা ?”

    জয়ন্তর ঠোটে চিলতে হাসি, যেন অর্নবকে ব্যঙ্গ করছে তারপর বলতে শুরু করেজানিস, ত্রিশাকে কেউ ছুঁলে আমার মাথায় রক্ত উঠে যেত ভালবাসার মানুষকে সমাজের কাছে, পরিবারের কাছে নিজের নাম দিয়ে ভোগ করার সুখ আমি শুধু ধারনাই করতে পারি তুই টাকার জোড়ে মানুষটাকে তো পেলি, কিন্তু তার আত্মাকে তৃপ্তি দিতে পারলি না

    এবার থেকে তুই প্রত্যেক মুহুর্তে ভাঙবি, প্রত্যেক মুহুর্তে ভাঙবে তোর অহংকার, যেমন আমার ভেঙেছিল বিশ্বাস কর, আমি খুব মজা পাব এই সময়টার জন্য আমি বহুদিন অপেক্ষা করেছি এই মজাটা তুই টাকা দিয়ে মেটাতে পারবি না।আরো কিছু হয়তো জয়ন্ত বলতো তারমধ্যে অর্নবের হাত থেকে গ্লাসটা পরে গেলো শক্ত চোয়াল, ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস পরছে অর্নবের বিশ্বাস করি না আমি, তুই মিথ্যে বলছিস
    অর্নবের কথা শুনে জয়ন্ত খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে উফ কি বিরক্তিকর হাসি, কানে লাগে, অসয্য লাগছে সে আওয়াজ
    জয়ন্ত মোবাইল বার করে অর্নবের হাতে ধরায় তাতে চলছে অশ্লীল চলচিত্র সাপ ব্যঙের, খাদ্য-খাদকের খেলাঘর যেখানে খাদ্য প্রতিবাদ করে না, প্র্শ্যয় দেয় একে অপরকে কামড়াচ্ছে, খিমচাচ্ছে আর চলছে একে অপরের নাম ধরে অকথ্য ভাষায় গালাগালি। এই যেন তাদের শেষ রাত। অর্নব আর সহ্য করতে পারছিলো না। খুব ভালোভাবেই জয়ন্ত সেটা বুঝতে পারছিলো।তোর বউ আমায় বলেছে যখন আমি ওকে কাছে পাব না তখন যেন আমি এটা দেখে নিজেকে শান্ত করি।আবার হাসেতোর্ সবতো শেষ অর্নব, এবার তুই কি করবি ?”

    সেদিন জয়ন্তর সাথে আমার দেখা হয়েছিল পচা একটা গন্ধে যখন আমার জ্ঞান এলো দেখি পুরানো আলমারির আয়নার ওপাশ থেকে জয়ন্ত আমায় দেখে হাসছে গন্ধটা ওর গা দিয়েই আসছে নোংরা একটা খেলা খেলে আসছে এতদিন ধরে, ওর মানসিক চিন্তা-ধারা পচে গেছে হাতে কি ছিলো জানি না, ছুড়ে মারলাম আয়নাটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো পায়ের কাছে পরে থাকা একটা কাঁচের টুকরোতে দেখা যাচ্ছে তখনও জয়ন্তর কুত্সিত চেহারাটা তখনও হাসছে , যেন বলছেপ্রতিশোধ তো আমাকে দিয়েই নিলি, ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে গেছে, আজকে আমাকে নোংরা মনে হচ্ছে ? আমার গা দিয়ে গন্ধ বেরোচ্ছে ? আমার জন্যই তো হলো সব

    ত্রিশার প্রানটা তখনও বেরইনি পেটের ওঠা নামায় শ্বাসের চলাচল উপস্থিতি জানায় তখনও ত্র্রিশার ছলছলে চোখ দুটো নীলচে কালো তারা মাখা আকাশের দিকে তাকিয়ে পাশে আন্ডার কনস্ট্রাকশনের আকাশছুই ইমারত যেখানের ওপর তলা থেকে কিছুক্ষন আগে ত্রিশাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে
    কলকাতার একটু বাইরে এরকম জায়গা অনেক পরে আছে, বছর বছর ধরে একইরকম অবস্থায় ত্রিশাকে অর্নব এরকমই এক জায়গায় নিয়ে এসেছিল নতুন ফ্ল্যাটের মাপকাটি দেখার অজুহাতে চারিদিক নির্জন, অর্নব হোমওয়ার্ক করেই এসেছিলো ত্রিশাকে বুঝতে দেয়নি বিন্দুমাত্র এমনকি তার রাগে লাল চোখ দুটো, যাতে ঘেন্না বেশি ছিলো না প্রতি মুহুর্তে মরার ভয় বেশি ছিলো সেটুকু দেখার বা বোঝার সুযোগ দেয়নি ত্রিশাকে।
    কিছুক্ষনের মধ্যে ত্রিশার প্রানটা বেরিয়ে যাবে, মুহুর্তে মুছে যাবে ছোটো থেকে মনে মনে পুষে রাখা অভিমান, নিজের প্রতি ভালবাসা, অন্যের প্রতি অভিনয় মুছে যাবে, যে কাকিমার দেখাশোনায় বড় হলো সেই কাকিমার প্রতি অছেদ্দা করার আফশোস নিজে মা হওয়ার স্বপ্ন। নিজের সন্তানকে সেই সবরকম আনন্দ সুখ দেওয়ার ইচ্ছা যেগুলো সে কোনদিন পায়নি।
    কেউ কোনো সময়ে দেখবে হয়তো তারপর থানা-পুলিশও হবে সনাক্ত হবে লাওয়ারিশ লাশটার ।।

    সমাপ্ত

     http://www.alokrekha.com

    0 comments:

    Post a Comment

    অনেক অনেক ধন্যবাদ