শুভাশীষকে চিঠি' (এপিসোড ৭ )/মুনা চৌধুরী
EPISODE 7
নিলিশ্বরী,
নীলকণ্ঠের এই গল্পটা শুনিনি, কিভাবে শুনবো বলো তোমার সাথে ১৯ বছর ধরে তো কথাই হয়নি! হেসোনা, পুরানের গল্পগুলি তুমি মন দিয়ে পড়তে আর অনেক সময় জোর করে আমায় শোনাতে। আমিও ভান করতাম গায়ে মাখছিনা, কিন্তু আসলে বাধ্য ছেলের মতো অবাক হয়ে তোমার গল্পগুলি শুনে যেতাম ! তুমি বলতে আমি তোমার অর্জুন, কেননা আমি ছিলাম তোমার উদ্ধারদাতা আর তাই তুমি নাকি স্বয়ংবরা হয়ে দ্রৌপদীর মতো আমার গলায় মালা পড়িয়েছিলে।
যদিও শ্রদ্ধা করতে যুধিষ্ঠির’কেই বেশি, কিন্তু বলতে কুরুক্ষেত্রের শেষে একমাত্র যুধিষ্ঠিরই সবার আগে স্বর্গের গন্তব্যে পৌঁছুতে পেরেছিলো কেননা সে ছিল সবার চাইতে “শুদ্ধ”। কিন্তু অর্জুন ছিল শুদ্ধ আর ত্রুটির মিশ্রণ ঠিক যেমনটা ছিলাম আমি। হেসে বলতে, ভালোবেসেছিলে তুমি প্রাণের চাইতেও বেশি আমাকে, এক অশুদ্ধতা আর শুদ্ধতায় মেশানো অর্জুনকে । শুদ্ধতায় মোড়া দেবতুল্য যুধিষ্ঠির এর মতো কাউকে তুমি ভালোবাসোনি।
আমি যদিও স্বভাবগতভাবে হো হো করে হাসতাম কিন্তু তোমার এসব শুনলে আসলে খুব ভয় পেতাম। ভয় হতো আমার নিজের উপর। আমি বুঝেছিলাম তুমি চিনতে পেরেছিলে এক বেয়াড়া আমাকে, যে পৃথিবীর সবার কাছে ছিলো অবাধ্য, অসভ্য আর সেই অবাধ্য, অসভ্য আমি কিছুতেই তোমার ভালোবাসার কাছে বাধ্য হবার ছিলাম না। আমরা দুজন দুজনকে অদ্ভুতভাবে চিনতে পেরেও আবিষ্কারের নেশায় মত্ত থাকতাম কেননা,
“তোমার সাথে আমার প্রতিটা মুহুর্তেই ছিল উৎসব,
প্রতিটা তুচ্ছ বাক্যালাপও ছিল অন্তহীন নদীর কল্লোল,
প্রতিটি কটাক্ষই ছিল অনিঃশেষ বসন্তকাল,
তুমি যতোক্ষণ থাকতে আমার এই হাতে দেখতাম ইন্দ্রজাল,
আঙুলে নেচে বেড়াতো চঞ্চল হরিণ;
তোমার সান্নিধ্যের প্রতিটি মুহূর্তই যেন ছিল সঙ্গীতের অপূর্ব মূর্ছনা,
যেন কারো অবিরল গাঢ় অশ্রুপাত;
তোমার সাথে আমার প্রতিটি বাক্যই যেন ছিল একেকটি কবিতা” যেমনটা মহাদেব সাহা লিখেছিলেন !
শোনো, খুব বেশি ভালোবাসা মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়, বেঁধে রাখতে পারে
না। তুমি সাদ খান এর লেখা Ruttie Jinnah: The Woman who Stood Defiant বইটা পড়েছো ? গত জন্মদিনে আমার এক বন্ধু দিয়েছিলো। কে জানতো একজন
পাথর-হৃদয় মানুষ নাকি লণ্ডনের গ্লোব থিয়েটারে রোমিও চরিত্রে অভিনয় করার স্বপ্ন
দেখতো। ইস্পাত-হৃদয়হীন, চল্লিশছোয়া বারিস্টারবাবুও নাকি ভালোবেসেছিলো ষোড়শী,
অপাপবিদ্ধ রত্তনবাঈ পেটিটকে, আত্মসমর্পিত হয়ে! মাত্র ২৯ বছর বয়সে রত্তনবাঈ যখন
মৃত্যুশয্যায় ও জিন্নাহকে লিখেছিলো, “I have suffered much
because I have loved much ---The measure of my agony has been in accord to the
measure of my love. And had I loved you just a little less I might have
remained with you – only after one has created a very beautiful blossom one
does not drag it through the mire.” চিঠির শেষে ও বলেছিলো, “Try to remember me as the flower you plucked and
not the flower you tread upon”. যখন বইটা পড়ছিলাম তোমার কথা মনে পড়ছিলো, হয়তো তুমিও আমার আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়ে, সবশেষ শাস্তিটা আমাকেই দিয়ে যাবে।
ইতিহাস তোমার প্রিয় বিষয় ছিল তাই তোমায় গল্পটা বললাম। আমার এখনো মনে আছে তুমি কি কি ভালোবাসতে। সবচাইতে ভালোবাসতে আমার কাছে গল্প শুনতে। পৃথিবীর মানুষকে নিয়ে কালের আবর্তনে সব সুন্দর, অবিশ্বাসী ভালোবাসার গল্পগুলি যেন আমি তোমায় আমৃত্যু বলে যেতে পারি।
শুভাশীষ
২৩শে অগাস্ট ২০১৬,
টাওয়ার হিল, লন্ডন
শুভ,
তুমি ভুল বললে। আমি সবচাইতে ভালোবাসতাম তোমার গলায় গান শুনতে। রোজ তোমার খালি গলায় আমি গান শুনতে চাইতাম।
রত্তনবাঈ পেটিট, যাকে সবাই রুটটি বলেই চেনে ওর কবিতা পড়েছি; তবে এই বইটা পড়িনি আগে। লিংকন'স ইন এর ডিনার হলে ঠিক বেরোবার পেছনের দরোজায়, যেখানে আমরা ছাত্ররা ওভারকোট রাখতাম, জিন্নাহর একটা বিরাট তেলরং ছিল। পাকা হাতে আঁকা তেলরং; যতবার ছবিটা দেখতাম ৫২’র ভাষা আন্দোলন মনে পড়তো। ভীষণ রাগ আর বিরক্ত লাগতো। সেই রাগ, বিরক্তি আমার দেশপ্রেম আর ভাষার জন্য শ্রদ্ধাবোধ থেকেই আসতো। কি অদ্ভুত এই মানব জীবন, ইস্পাত-হৃদয় মানুষেরাও নাকি প্রেমময় হয়! রুটটির লেখা একটা কবিতা পেলাম, মনে হলো সময়কে সাক্ষী রেখে কোনো অভিমানী প্রেয়সী তার মৃত্যুশয্যায় লিখে গেলো, “Love came
to me once in flower-like sweetness " ……
"ভালোবাসা একবার আমার কাছে মিষ্টি ফুলের সুগন্ধ হয়ে এসেছিল,
আমি সেই গন্ধ নিতে থাকতাম যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি তৃপ্ত আর অসুস্থ হয়ে উঠতাম।
দুঃখ তার কৃষ্ণ কালো অনিন্দসুন্দর আবরনে হাজির হতো,
কিন্তু সে আমাকে ছেড়ে যেত না ।
আমি সেই বিষাদের পেয়ালা গভীরভাবে পান করে যাই -
যখন আমি জেগে উঠি এবং যখন আমি ঘুমাই:
যখন আমি হাসি এবং যখন আমি কাঁদি
আমি ওর স্বাদ নিতে থাকি কেননা
দুঃখ তৃপ্তি জানে না"।
জিন্নাহকে ও ডাকতো “Lone Wolf” বলে। রুটটি তার এই 'নিঃসঙ্গ নেকড়ে'র জন্য কবিতাটা লিখেছিলো যা সে সরোজিনী নাইডুর সাথে ভাগ করে নিয়েছিল। কবিতাটা ছিল ওর শেষ চিঠি যা লেখার ২ দিন পর, ২৯তম জন্মদিনে ও ক্যান্সারে মারা যায়। রুটটি মনের সব গোপন কথা সরোজিনী নাইডুকে বলতো কেননা ওরা প্রাণসখী ছিল, এমন সখী যাকে সব বলা যায়।
প্রাণ সখীদের কথা বলতেই আমার প্রাণসখীর কথা মনে পড়লো। মনে আছে তোমার কৃষ্ণকলিকে? আমার তামিলনাড়ুর বান্ধবী যাকে তুমি ‘বিদেশী টিউব লাইট' বলে ডাকতে। ওর সাথে আমার এখনো মাঝে মাঝে কথা হয়। কথা হলেই ও তোমার কথা জানতে চায় আর সেইসব দিনের কথা নিয়ে আমরা এখনো হাসি। তোমার কাছে যেদিন ও আমায় প্রথম নিয়ে গিয়েছিলো, মনে পড়ে? আমরা ষড়যন্ত্র করেছিলাম তোমাকে surprise দেব আর কিছুক্ষন পর ও আমায় রেখে চলে আসবে। কিন্তু দুষ্টুটা গল্প জুড়ে দিলো তোমার সাথে। আসলে পাজিটা আমায় ক্ষেপাচ্ছিলো আর তুমি সেটা বুঝতে পেরে মজা নিচ্ছিলে। রাগ আর বিরক্তি যেন আমার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিলো। তুমি খুব মুচকি হেসে রসিয়ে রসিয়ে ওর সাথে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিলে। যতবার আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম তুমি বিজয়ের ভঙ্গিতে আমায় থামিয়ে দিয়ে বলছিলে, “now, let
me just put a
lid on you”! ভাবছিলাম এই অসভ্য, বেয়াদব, উজবুকটাকে কেনযে আমার ভালোবাসতে হলো!
সব ভালোবাসায় কিছু মিষ্টি গল্প থাকে, আমাদেরও নাহয় থাকলো। জীবনের এতটা পথ পাড়ি দিয়ে, এই গোধূলিবেলায় কষ্টের দিনগুলির কথা মনে করতে চাইনা। তোমায় নিয়ে আমার সব দুষ্টু মিষ্টি গল্পগুলি যেন আমায় বাঁচিয়ে রাখে, আমার অন্তর জুড়ে থাকে বাকিটা সময় ……
"জ্যোৎস্নায় দুরন্ত চাঁদে ছুঁয়ে যাওয়া,
নীল দীর্ঘশ্বাস কোনো মানুষের!
সত্যিই কি মানুষের?
তবে কি সে মানুষের সাথে সম্পর্কিত ছিল, কোনোদিন
ভালোবেসেছিল সেও যুবতীর বামহাতে পাঁচটি আঙুল?
ভালোবেসেছিল ফুল, মোমবাতি, শিরস্ত্রাণ, আলোর ইশকুল?" -আমাদের প্রিয় আবুল হাসান থেকে।
ভালো থেকো।
নীল
২০'শে সেপ্টেম্বর ২০১৬,
ধানমন্ডি, ঢাকা
নীল,
"বন্ধু তোমার লাগিয়া সদাই প্রান আমার কাদে"।তোমার চিঠিগুলি পড়লে সেই সব দিনের অনেক না বলা কথা বলতে ইচ্ছে করে। অনিষ্পন্ন যত কথা, মনের মধ্যে আটকে থাকা যত কথা। আমার সব নিচুতা, পশুত্ব আর অসংলগ্নতার কথা, সব বিষণ্ণতা আর পৃথিবীর প্রতি যত বীতশ্রদ্ধা - সব কিছু তোমাকে বলতে ইচ্ছা করে। হয়তো কোনোদিন বলবো। সময় হলে বলবো।
এতটা বছর পেরিয়ে, এতটা কাল কাটিয়ে এখনো বুঝি- তোমার মত বন্ধু হয় না। এখনো চোখ বন্ধ করলে তোমার গায়ের গন্ধ পাই। তোমার মায়ামাখা ভালোবাসা, বার বার আমাকে বুঝতে চেষ্টা করা, তোমার ক্ষমা করার প্রবণতা। Hans Christian Andersen এর মৎসকন্যার মতো তুমি অর্ধেক মানবী, অর্ধেক ঈশ্বরী: নিলিশ্বরী। তোমার মানব-ঈশ্বরী মন নিয়ে, এতো কিছু দেখে, প্রশ্নহীন থেকে, নিশ্চুপ হয়ে, তোমার প্রতিটা প্রার্থনায় আমাকে বাঁচিয়ে রাখা - তুমি কি ভাব আমি জানতাম না? এর প্রতুত্তরে কি বলবো তোমায়, সেইসব দিনগুলির কোন সত্যিগুলো বলবো, কতখানি বলবো, তোমার কষ্টের ভার কি কমবে নাকি আরো বাড়বে?
কোনো এক অজানা লেখক বলেছিলো-
“Grief never ends, but it
changes.
It's a passage and not a
place to stay.
Grief is not a sign of
weakness nor a lack of faith.
It's the price of love.”
It's a price you consecrate
daunting. Price you paid for loving me, loving a hollow man, a hollow soul. কিন্তু আমি জানতাম তোমাকে এই ভালোবাসা নিয়ে যাচ্ছিল স্বর্গের কাছাকাছি। শোন, তুমিতো শুধু নিজের কষ্টের জন্য কাঁদতে না, আমাকে পাবার জন্য কাঁদতে না। তুমি কাঁদতে আরও নিঃস্ব হয়ে, শূন্য হয়ে, যিনি তোমাকে পরম আদরে তৈরী করেছেন ভালোবাসায় গড়েছেন।
শুভাশীষ
২২'শে অক্টোবর ২০১৬,
টাওয়ার হিল, লন্ডন
শুভাশীষ,
"নহে নহে প্রিয় এ নয় আঁখি-জল / মলিন হয়েছে ঘুমে চোখের কাজল / হেরিয়া নিশি-প্রভাতে শিশির কমল /পাতে ভাব বুঝি বেদনাতে ফুটেছে কমল”। নজরুল বলছে সকালের শিশিরের কারণে পদ্মফুলের পাপড়িতে যে ভেজা ভাব দেখা যায়, তা দেখে মনে হতে পারে যেন পদ্মফুলটা বেদনাতে কেঁদেছে, কিন্তু আসলে এটা শিশিরের প্রভাব। মানুষের সব বেদনার সূত্রপাত হয়তো অসীমকে বোঝার শুরু থেকেই। তাই তুমি ঠিকই বলেছো আমার মতো হৃদয়সর্বস্ব, বোকা মেয়েটা তোমার জন্য কাঁদিনি। যিনি আমাকে পরম আদরে গড়েছেন, আমার ভেতর রুহু ফুঁকে দিয়েছেন, আমার পাশে ভীষণ বিষন্ন সময়ে অবিচল দাঁড়িয়ে থেকেছেন, আমি তার জন্য কেঁদেছি। তুমি শুধুই 'উপলক্ষ'!
“Blessed are the meek
for theirs is the kingdom of God”, and being meek is not weak or timid rather
being humble with the trust in the glorious Almighty. আর তুমি তো জানোই এটাই আমার স্বরূপ, ভালোবাসায় অন্ধবিশ্বাসী। তাই আবারও বলি, ভালো সেই ভালো আমারে না হয় নাই জানো, আর আমিও নাহয় জানি তোমার অন্ধকার দিকটার কথা। Ignorance is bliss,
especially when it comes to you.
আমি শুধু মনে করতে চাই সেই মহাকালের কথা যখন আমরা রবিঠাকুরের 'শেষ বসন্ত'র বেনু বনচ্ছায়া ঘন সন্ধ্যায় বেঁচে থাকতাম গোধুলীর বাঁশরীর সর্বশেষ সুর হয়ে। বাবা সবসময় আবৃত্তি করতেন এই পঙতিগুলো কেননা ওটা ছিল বাবার প্রিয় কবিতা। আমার বয়স তখন পাঁচ কিংবা ছয়, বাংলা একাডেমীর এক রবীন্দ্র উৎসবে বাবা তার প্রিয় কবিতাটা আবৃত্তি করেছিলেন। আমি গুটি গুটি পায়ে বাবা মায়ের হাত ধরে গিয়েছিলাম আর সামনের সারিতে বসে দেখছিলাম। দিলশাদ খানম নামে একজন দারুন অনন্য-সাধারণ অভিনেত্রী তখন নাটক করতেন সাদাকালো বাংলাদেশ টেলিভিশনে। এখনো চোখে ভাসে কি দুর্দান্ত আবৃত্তি দুজনার: স্পষ্ট, শুদ্ধ, আবেগী, অনবদ্য। They were a brilliant duo আর বাবা তো চিরকালই natural
when it came to anything artistic.
এসব বললাম একারণে যে বাবার মেয়ে হয়েও আমার বাবার মতো প্রতিভা ছিলোনা, তাই হয়তো ভয় হতো তোমার মতো মানুষের সাথে পথচলতে।ভাবতাম তুমি বাবার মতো একজন- অসাধারণ, বুদ্ধিদীপ্ত, দুর্দান্ত যে বাবার মতো গান গাইতো, আবৃত্তি করতো আর নানা বিষয়ে বই পড়তো। যে আমাকে শিখিয়েছিলো জীবনের অন্য এক পাঠ। মানুষ যখন কাউকে ভালোবাসে সে জানে না আসলে তার ভালোবাসার মানুষ অন্য দশজন মানুষের মতোই অতি সাধারণ। We create our loved ones
with our most glorious imagination. ওই যে তোমার প্রতি আমার মুগ্ধতা, যেকারণে তোমার সবকিছু আমাকে সম্মোহন করতো। আমি চাইতাম তোমার
কাছে একজন সহজ মানুষ হয়ে থাকতে: ভজে দেখ না রে মন। কিন্তু আমি জানতাম তুমি আমার
পাশে থাকবে না। ক্ষুদ্র এই আমি নিরন্তন বলে যেতাম “হাসবুন আল্লাহ ওয়া
নিয়ামুল ওয়াকিল”- “অবিনশ্বরীই আমার জন্য যথেষ্ট, এবং তিনিই উত্তম কর্মবিধায়ক”।
আমি চোখ বন্ধ করে বলে যেতাম যে পৃথিবী তোমার মুখাপেক্ষী, আমাকে তার মুখাপেক্ষী করো
না। পরনির্ভরশীল, পরপ্রত্যাশী হয়ে আমি বাঁচতে চাইনা। আমি বলে যেতাম কারণ আমি দেখতে
পেতাম এই সুখ আমার বেশিদিন সইবে না। আর সেটাকে তুমি সত্যি করে দিয়ে একদিন
একনিঃশ্বাসে, ভাবলেশহীন ভাবে বলে ফেললে, "ভবিতব্য"।
তবে বিধাতা সদয় ছিলেন সেই প্রথম দিন যেদিন আমরা দেখা করলাম। তোমার লাইব্রেরি থেকে চে’গেভারা'র একটা বই হাতে তুলে দিয়েছিলে, সেই সাথে আরো কয়েকটা বই। তুমি তো অবাক, যখন দেখলে চে’গাভারার উপর আমার কোনো আগ্রহ নেই। সত্যিটা ছিল বই পড়ার ধরে কাছেও আমি কোনোকালে ছিলাম না। তোমার উল্টোটা ছিলাম আমি, একেবারে অষ্টরম্ভা। পছন্দ করে নিলাম কি যেন একটা বেরসিক বই আর তুমি দুষ্টু হাসি হেসে ওটাতে লিখে দিয়েছিলে “to the
coolest girl” অথবা এই জাতীয় কিছু একটা। আসল কথা দিনটা ছিল surreal
like a dream; যেন আমি পরাবাস্তব জগতে আলোকিত কিছু একটার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। প্রাণ খুলে আমি গাইতাম রবিঠাকুর -
“বালক বীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়, এ কী গো বিস্ময়
অবাক আমি তরুণ গলার গান শুনে, দেখা পেলেম ফাল্গুনে ….
গন্ধে উদাস হাওয়ার মতো উড়ে তোমার উত্তরী,
কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরী,
তরুণ হাসির আড়ালে কোন্ আগুন ঢাকা রয়, এ কী গো বিস্ময়” !
আমি খুব অল্প কিছু পারতাম, যার মধ্যে কিছু সপ্ন দেখার বরাভয়, আর তুমি সেই স্বপ্নে খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে তরী বইবার শিরদাঁড়া প্রত্যয় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। তুমি ছিলে ঋজু, রক্তের মত নিশাচর, যুবকের মত বরাভয়, প্রমত্ত পদ্মার মত উছল তরঙ্গ, আর মাথা নত না করা একজন। তোমার কাছে আমার কত ঋণ, তোমার এ ঋণ আমি শুধি চিরদিন।
নীল
১০'ই নভেম্বর ২০১৬,
ধানমন্ডি, ঢাকা
নীল,
আজ অনেক ভোরে বাবার ফোন, মা হটাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। সারাদিন আমার সবকিছু ওলোট পালট লাগছিলো। মনে মনে জপে যাচ্ছিলাম - মা ভালো হয়ে যাও, get well
please. Aren't you my life line? You can't leave me alone in this dungeon. কত স্মৃতি ছেলেবেলার, মা গান শেখাতো আমাদের ভাইবোনদের। নিজে হারমোনিয়াম নিয়ে বসতো। মামা, খালাদেরও নিয়ে বসতো। বৃষ্টির দিনে মায়ের গলায় মিঞা মালহার … ম প ন ধ ন প র প ম প গ গগ রস। মা বলতো তার গুরু বলেছিলেন মিঞা মালহার বা অমৃতবর্ষিণী নাকি বৃষ্টি ঘটাতে পারে। দক্ষিণ ভারতের কোন একটা খরা পীড়িত গ্রামে নাকি বৃষ্টির আহ্বান জানানো হয়েছিল বিখ্যাত "অন্নদামৃত বর্ষিণী" গেয়ে। আর পুরাণে নাকি আছে হনুমান যখন লঙ্কায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন, তখন রাবণ বীণায় অমৃতবর্ষিণী রাগ বাজিয়ে বৃষ্টি ডেকেছিলেন। তাই যখনি বৃষ্টি হতো মা ওর তানপুরাটা নিয়ে বসে যেত।
রোজ ভোরে আমি মায়ের জন্য কোরান পড়ি, আজকে মায়ের জন্য গাইলাম। আর এই গানটা তুমিও শুনতে চাইতে সবসময়। মাও গাইতো ওটা দারুন সুরে, "ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সংগীত ভেসে আসে / কে ডাকে কাতর প্রাণের মধুর ডাকে"। ভাবতো, সৃষ্টিকর্তা সবসময় এগিয়া থাকেন তাঁর হতভাগ্য বোকা সন্তানদের নিজের রাজ্যে ফিরিয়া নেবার জন্য আর তাই আমাদের তার কাছে ফিরে যাবার অপেক্ষায় প্রহর গোনা। এই গানটাতে মায়ের সমর্পন অপার্থিব থাকতো আর তাই শেষটায় মা প্রাণ ঢেলে গাইতো, "ওরে মূঢ়, ওরে অন্ধ, কেন কারাগারে আছিস বন্ধ …. কেন ঘরের ছেলে পরের কাছে পড়ে আছিস পরবাসে?" মা অপূর্ব ঐশ্বরিক আহবানে আরেকটা গানও গাইতো, "ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু / পথে যদি পিছিয়ে, পিছিয়ে পড়ি কভু.."।
"রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা"। মনটা ভীষণ উথাল পাথাল। মাকে কি তুমি একটু গিয়ে দেখে আসবে ?
শুভাশীষ
১৪'ই ডিসেম্বর ২০১৬,
টাওয়ার হিল, লন্ডন
শুভ,
গিয়ে দেখে এসেছি তোমার মাকে। না ভালোবেসে কি থাকা যায় ভালোবাসার মানুষের মাকে? পাহাড় পর্বত নিয়ে লেখা সহজ, ওঠা কঠিন। তেমনি মা এর মত অত গুণী হওয়া সহজ নয়। অসাধারণ এই মায়ের ছায়াতলে তুমি পেয়েছিলে অরুপের সন্ধান। মা একটু নরম হয়ে গেছে কিন্তু ভালো আছে। সব ঠিক হয়ে যাবে, তুমি ভেবোনা। আমি কিন্তু বসে রইলাম তোমার এই অনিন্দসুন্দর ছেলেবেলার আরো অনেক গল্প শুনবো বলে।
জানো, আজকাল মনে হয় আমি কেমন যেন একটা অপ্রাপ্তির জীবন পার করছি, অথচ কত ভালোবাসায় ছেলেবেলায় বড় হয়েছি। আমার কমলারঙা শৈশব ছিল মগবাজারে আমার দাদাবাড়ি "শ্যামলী"তে। ওখানে আমার জন্ম আর বেড়েওঠা। শ্যামলী সত্যি ছিল শ্যামলিমায় ভরা। শ্যামলীর গেট এ দাঁড়িয়ে থাকতো একটা গন্ধরাজ গাছ যেটাতে স্নিগ্ধ, শুভ্র সাদা গন্ধরাজ ছেঁয়ে থাকত আর পাশে বাগানটাতে ছিল থোকা থোকা হাস্নাহেনার গাছ । বাড়িটাতে ঢুকতেই বিশাল ফুলের বাগান যা আধখানা চাঁদের মতো আকার নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির ফুলে ছেয়ে থাকতো। আরো অনেক গাছ ছিল যা নিজ হাতে লাগিয়েছিল আমার দাদাভাই; কত ফলের গাছ যেমন আম, জাম, পেয়ারা, আতাফল, গোলাপজাম, জামরুল, আর সেই সাথে কত লতানো গাছ। ওগুলো বাড়ির দোতলা ছাড়িয়ে জড়াজড়ি করে বিষ্ময়কর ভাবে বেড়ে উঠত। শিরদাঁড়া উচু, স্নিগ্ধ সুরভিত ফুলের গাছ গুলি আর অপার সৌন্দর্যে বিশাল ফলের গাছগুলি নিভৃত শক্তি নিয়ে, করুনাময়ের অসীম দয়া নিয়ে, আমাদের জীবনীশক্তি দিয়ে যেত।
দাদাভাই তার ৩৮বছর বয়সী প্রেমময়ী স্ত্রীকে হারিয়ে, ৯ সন্তানকে বুকে আগলে বেঁচে ছিলেন আজীবন। দাদি ছিলেন ক্ষণজন্মা মানুষ, হৃদয়টা কাদা মাটির মতো নরম, গরিব দুঃখীর জন্য অন্তপ্রাণ ! শরৎচন্দ্র পড়ে চোখের জলে ভাষতেন। দাদাভাই বিয়ে করেননি দাদি চলে যাবার পর। নতুন করে তিনি শ্যামলী তৈরী করেছিলেন তার প্রিয়তমাকে ভেবে ভেবে। শেষ জীবনে অবসর নিয়েছিলেন নতুন বাড়িতে- দেশের শীর্ষ উকিল আর সুখ্যাত রাজনীতিবিদ হয়ে। জীবনের ইতি টেনে ছিলেনও এখানেই। ‘শ্যামলী’ নামটা বাবাই দিয়েছিল কারণ বাড়িটা শ্যামল ছিল। দাদাভাই অনেকটা নতুন জীবন দিয়ে গিয়েছিলেন এভাবে তার সন্তানদের। বাবা সবসময় বলেন তিনি বেহেশতে গেলে এই শ্যামলী বাড়িটাকেই চাইবেন, কোনো মণিমুক্তাখচিত রাজ্প্রাসাদ চাইবেন না। এই শ্যামলীকেই চাইবেন, যেখানে তার বাবা মা একসাথে থাকবে রাজা রানী হয়ে, তার পরিবারের সবাইকে ঘিরে। It would be in his top
wish-list. লোকে বলবে emotional
fool, যা আসলে বাবা আর আমি দুজনেই।
আজ গুছ গুছ কৃষ চূড়ার মত, ছেলেবেলার অজানা কোন ঋন এর মত, আমার জীবন মরনের সীমানা পেরিয়ে, রয়েছে দাড়ায়ে বাবার সেই স্বপ্ন, সেই wish list.
আমাদের সবার একসাথে স্বর্গে বসবাস, আমাদের অনিন্দসুন্দর পরকাল। দাদাভাই আর দাদীর সেই ওমর প্রেমগাঁথা যা পৃথিবীর হাটে কেউ পাবে না- যে গল্প আমার হৃদয়এ রয়ে আছে জলছবি হয়ে।
হয়তো এই ভালোবাসাই আমি দেখতাম তোমার দুচোখে। অপার মমতা, যা তুমি আমায় দিয়েছিলে, কম সময়ের জন্য, কিন্তু দিয়েছিলে তো। জীবনটাই রুপকথা যেখানে সপ্ন, দুঃসপ্ন আদুরে বেড়াল হয়ে লুটোপাটি খায়। এ যেন ইমন হতে না হতেই মালকোশ এর বেলা। কিছুটা বুঝি, বাকিটা অস্পষ্ট।
নীল
১৭'ই ডিসেম্বর ২০১৬,
ধানমন্ডি, ঢাকা
নীল,
How eloquently you penned
your words. It brings tears and a gush of emotions in my stoic heartless mind. যখন তোমার চিঠি পাই একটা শান্তির চাদর আমায় মুড়ে রাখে। তোমার কথা শুনে যাই।
আমাদের অতীতের নির্মল আনন্দের দিনগুলি, গভীর স্মৃতিমেদুরতা আর সেই স্মৃতিতে তুমি কিছুটা রহস্য। Your recollections ring
like the sweet chime that hangs in my soul garden. যা পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। পেয়েছি অবিনশ্বরকে আর সেটা তোমাকে দিয়েই। সেকারণেই যুগ যুগান্তর ধরে আমাদের দেখা হওয়া অথবা না হওয়ায় কিছু এসে যায়নি কারণ আমরা ছিলাম অবিনশ্বরের বিনি সুতোয় গাঁথা মালা।
আমার সব অক্ষমতাগুলোকে কি তুমি ক্ষমা করতে পেরেছো?
শুভাশীষ
২০'শে ডিসেম্বর ২০১৬,
টাওয়ার হিল, লন্ডন
প্রিয় জার্মান চকলেট,
তোমাকে পুরোটা বুঝতে পারিনি সত্যি তবে কিছু তো বুঝতাম। তাই তোমাকে ক্ষমা করার বা না করার বিষয় কখনোই মাথায় আসেনি। মনে আছে তুমি বলতে, “ঈশ্বরের বায়ুচক্রে সব ধূলিকণা হয়ে যায়”। Like the Sufis say all turn to dust in the windmill of God. কিন্তু আমি তোমায় বলতাম "but my love for you will never turn to dust, rather it will be flowing in paradise as the scent of musk surrounding you”. কস্তুরীর সুগন্ধ হয়ে আমার ভালোবাসা বেহেশতে তোমার চারপাশে ঘুরে বেড়াবে। তুমি হাসতে। God has such mercy in the hidden trails. পবিত্র গ্রন্থে বলা আছে, যারা একে অন্যকে ভালোবেসেছে "অবিনশ্বর এর জন্য” তাদের জন্য কেয়ামতের দিনে আলোর আসন থাকবে, এবং শহীদরা ও তাদের ঈর্ষার চোখে দেখবে! তুমি কখনো ভুলবে না আমি তোমাকে ভালোবেসেছি অবিনশ্বর এর জন্য। I have loved you 'for the sake of God'.
আমি যখনি তোমায় বলতাম তোমার ওই দুঃখভরা চোখদুটো আমার সবচাইতে প্রিয়, তুমি হেসে বলতে “কি দেখলে তুমি আমার চোখে"? আমি বলতাম, “Beauty
lies in the eyes of the beholder”. তুমি মজা করে বলতে, “n the
beerholder“? অদ্ভুত stoic মানুষ ছিলে তুমি আর তোমার কথাবার্তা। সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তোমার হেসে উড়িয়ে দেয়া। রবিঠাকুর ঠিক যেভাবে বলতেন, "তোমারে পাছে সহজে বুঝি তাই কি এত লীলার ছল— বাহিরে যবে হাসির ছটা ভিতরে থাকে আঁখির জল"।
“What if God was one of us
Just a stranger in the bus
Trying to make his way home
None to pick up the phone?”
… শুনছিলাম Joan
Osborne এর গানটা।
নীল
২৩’শে জানুয়ারী ২০১৭,
ধানমন্ডি, ঢাকা
প্রিয় নিলিশ্বরী,
“আমরা দুজনা স্বর্গ-খেলনা গড়িব না ধরণীতে,
মুগ্ধ ললিত অশ্রুগলিত গীতে। …….
পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি,
ছিন্ন পালের কাছি, মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব--
তুমি আছ, আমি আছি” - রবিঠাকুরের 'নির্ভয়' এর মতো জীবনে যত কঠিন পরিস্থিতি আসুক, নদী পার হতে গিয়ে নৌকা ডুবে যাক বা পাল ছিঁড়ে যাক, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও আমরা যেন দুজনকে দুজন খুঁজে পাই।
Those who are gifted by the
'Qiyam of Allah' will be reckoned and thanked with tears. সময় আমাদের মনের বেদনাকে আরোগ্য করে না, তবে সৃষ্টিকর্তার উপর আমাদের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে হৃদয়ে এক অসাধারণ সুবাস নিয়ে আসে। আমাদের বাবা, মায়ের দুর্দান্ত বংশাণু আমাদের বাঁচিয়ে রাখে ভীষণ দুর্যোগেও। আমরা সৃষ্টিকর্তার পুনর্নবীকরণ এবং তাঁর মহান পরকালের জন্য প্রস্তুত হই আর বাঁচতে শিখি। আমরা তৈরী হই সৃষ্টিশীল মানুষে, আর কাজ করে যাই পৃথিবীর জন্যে যেমন ন হন্যতে অমৃতা আর মির্চা করেছিল ।
“Nothing you love is lost.
Not really. Things, people—they always go away, sooner or later. You can’t hold
them, any more than you can hold moonlight. But if they’ve touched you, if
they’re inside you, then they’re still yours. The only things you ever really
have are the ones you hold inside your heart”― Bruce Coville এর মতো আমিও বিশ্বাস করি, তুমি করো ? .
শুভাশীষ
২৬’শে ফেব্রুয়ারী ২০১৭
টাওয়ার হিল, লন্ডন
শুভাশীষকে চিঠি' (এপিসোড ৭ )/---------মুনা চৌধুরীর এই চিঠিগুলো আসলে পূর্ণাঙ্গ এক সাহিত্যকাব্য। এগুলো শুধু দুজন মানুষের ব্যক্তিগত প্রেমপত্র নয়, বরং একেকটি সময়, অনুভব, ইতিহাস ও দর্শনের মিশ্রণ—যা পাঠ করলে মনে হয়, আমরা এক আত্মার গভীর জগতে ঢুকে পড়ছি। দারুন হয়েছে ।লেখককে আন্তরিক শুভেচ্ছা।
ReplyDeleteশুভাশীষকে চিঠি' মুনা চৌধুরীর এই চিঠিগুলো অনবদ্য ।চিঠিগুলির ভাষাশৈলী
ReplyDeleteকাব্যিক ভঙ্গি: প্রতিটি চিঠিই ছন্দ, উপমা ও রূপকে পরিপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা প্রমুখ কবিদের উল্লেখ ও উদ্ধৃতি ভাষাকে আরও সুরেলা করে তুলেছে। চিঠির পাঠক বুঝতে পারে, এরা শুধু ব্যক্তিগত চিঠি নয়, বরং একেকটি শিল্পকর্ম।দ্বিভাষিকতায় বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষার মিশ্রণ একটি আন্তর্জাতিক আবহ তৈরি করেছে। একই চিঠিতে রবিঠাকুরের কবিতা আর ব্রুস কোভিলের উক্তি পাশাপাশি আসা—এই মেলবন্ধন একদিকে আধুনিক, অন্যদিকে চিরন্তন।
শুভাশীষকে চিঠি' মুনা চৌধুরীর এই চিঠিগুলো পড়ে খুব ভাল লাগলো ।ভাষার আবেগপ্রবণতা: প্রতিটি শব্দের ভেতরেই আবেগের জোয়ার। লেখকেরা নিজেদের গভীরতম অন্তর মেলে ধরেছেন, যেখানে আত্মগ্লানি, ভালোবাসা, ঈশ্বরবিশ্বাস, ভয়, প্রত্যাশা—সব একত্রে জায়গা নিয়েছে। বিষয়বস্তুর গভীরতা ও ভালোবাসা অনন্য । ভালোবাসাকে এখানে স্রেফ ব্যক্তিগত সম্পর্ক হিসেবে ধরা হয়নি; বরং তা হয়ে উঠেছে মহাজাগতিক, আধ্যাত্মিক।"আমি তোমাকে ভালোবেসেছি অবিনশ্বরের জন্য"—এই বাক্যই এর সারমর্ম। ইতিহাস ও সাহিত্য: প্রতিটি চিঠিতে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের চরিত্র (যেমন জিন্নাহ-রুটটি, কুরুক্ষেত্র, চে গেভারা), সাহিত্যের চরিত্র (রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র), পুরাণ ও ধর্মের প্রসঙ্গ। পাঠক একদিকে প্রেমের কাহিনী পড়ছে, বিশ্বসাহিত্য, ইতিহাস ও পুরাণে ভ্রমণ করছে। অনেক নিরীক্ষাধর্মী লেখা । খুব ভাল থাকবেন আমাদের প্রিয় লেখক।
ReplyDeleteশুভাশীষকে চিঠি' মুনা চৌধুরীর এই চিঠিগুলো পড়ে খুব ভাল লাগলো । এত প্রতিক্ষার পর এ লেখা পেলাম । কি যে আনন্দ হচ্ছে । বারবার পড়ছি তত ভাল লাগছে । দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা: শোক, মৃত্যু, ঈশ্বর, স্বর্গ, পরকাল—এই বিষয়গুলো বারবার উঠে এসেছে। চিঠিগুলো যেন মানুষের জীবনযাত্রার অন্তিম প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি দাঁড় করায়। চরিত্র ও সম্পর্কচিত্র শুভাশীষ: নিজেকে অর্জুনের সঙ্গে তুলনা করেছে—অসম্পূর্ণ, বেয়াড়া, কিন্তু প্রাণবন্ত। তার ভেতরে আছে আত্মগ্লানি ও ভয়, তবুও গভীর ভালোবাসা। নীল/নিলিশ্বরী: তিনি কবি-হৃদয়ের অধিকারিণী, যিনি আধ্যাত্মিকতার চোখ দিয়ে ভালোবাসেন। তাঁর ভালোবাসা নিখাদ, ঈশ্বরনিষ্ঠ এবং আত্মসমর্পিত। তিনি যেমন স্মৃতিমেদুর, তেমনি দৃঢ়চেতা।দুজনের মধ্যে চিঠি বিনিময়ের ফলে সম্পর্কটা পাঠকের চোখে হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক—শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, বরং বন্ধু, সহযাত্রী, আধ্যাত্মিক সঙ্গী। অনবদ্য লেখনী ।
ReplyDeleteমুনা চৌধুরীর শুভাশীষকে চিঠি' এই চিঠিগুলো পড়ে খুব ভাল লাগলো । বহু প্রতীক্ষিত লেখা ।আবহ ও আবেগ এই চিঠিগুলির আবহে বারবার এসেছে স্মৃতি: শৈশব, পরিবার, মা-বাবা, দাদাভাই, শ্যামলী বাড়ি—এসব বর্ণনায় একরকম গৃহনিবিড়তা তৈরি হয়। বিরহ ও শোক: প্রতিটি চিঠিতে অনুপস্থিতির বেদনা স্পষ্ট। ভালোবাসা যত গভীর, ততটাই অনিবার্য হয়ে ওঠে হারানোর ভয়। আধ্যাত্মিক সুর: ঈশ্বরের প্রতি আস্থা, ভালোবাসাকে ঈশ্বরপ্রদত্ত শক্তি হিসেবে দেখা, কোরান-বাইবেল-গীতা-পুরাণের মিলিত সুর। সাহিত্যিক মূল্যায়ন এগুলো চিঠি আকারে লেখা উপন্যাস বললেও ভুল হবে না। প্রতিটি চিঠি আলাদা কবিতার মতো, আবার একত্রে তারা গড়ে তুলছে এক মহাকাব্যিক প্রেমগাঁথা।এর মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে সময়, সমাজ, ইতিহাস, ধর্ম, সাহিত্য, দর্শন এবং সর্বোপরি মানব-হৃদয়ের মহত্ত্ব ও ভঙ্গুরতা। এগুলোকে বলা যায় একধরনের আত্মিক সাহিত্য—যেখানে প্রেম ব্যক্তিগত নয়, বরং মহাজাগতিক হয়ে ওঠে। এটা শুধু প্রেমের চিঠি নয় একটা সাহিত্য ।
ReplyDeleteমুনা চৌধুরীর শুভাশীষকে চিঠি' এই চিঠিগুলো পড়ে খুব ভাল লাগলো । বহু প্রতীক্ষিত লেখা এটা শুধু প্রেমের চিঠি নয় একটা সাহিত্য ।এই চিঠিগুলো বাংলায় আধুনিক "প্রেম ও দর্শনের পত্রসাহিত্য"। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-শরৎচন্দ্রের মতো প্রভাব থাকলেও এগুলো সমকালীন, ব্যক্তিগত অথচ সার্বজনীন। এগুলো পড়লে মনে হয়, দুই আত্মার মধ্যে এক অন্তহীন আলাপ চলতে থাকে, যেখানে ভালোবাসা, মৃত্যু, স্মৃতি আর ঈশ্বর একই সাথে হাত ধরে এগোয়। অপূর্ব !!
ReplyDeleteমুনা চৌধুরীর শুভাশীষকে চিঠি' এই চিঠিগুলো পড়ে খুব ভাল লাগলো । বহু প্রতীক্ষিত লেখা এটা চিঠিগুলির রূপকথাময়তা।এই চিঠিগুলির প্রতিটি বাক্য যেন বাস্তব জীবনের ঘটনা থেকেও একধাপ ওপরে—স্বপ্ন, রূপকথা আর আধ্যাত্মিকতার জগতে। এখানে ব্যক্তিগত প্রেমকাহিনী নেই, বরং দুই আত্মার চিরন্তন সংলাপ আছে। "তুমি ছিলে ঋজু, রক্তের মত নিশাচর, প্রমত্ত পদ্মার মত উছল তরঙ্গ"—এমন বাক্যে প্রেমিক/প্রেমিকা হয়ে ওঠে প্রকৃতির প্রতীক। ফলে সম্পর্কটা কেবল ব্যক্তিগত নয়, মহাজাগতিক হয়ে দাঁড়ায়। দারুন অভিব্যাক্তি । বোঝায়ই যায় অনেক নিরীক্ষায় লিখিত । শুভ কামনা !
ReplyDeleteমুনা চৌধুরীর শুভাশীষকে চিঠি' পড়ে খুব ভাল লাগলো । বহু প্রতীক্ষিত লেখা এটা। চিঠিগুলির ভাষা মূলত গদ্য, কিন্তু পড়তে পড়তে বারবার মনে হয় কবিতা পড়ছি। এখানে অন্ত্যমিল নেই, কিন্তু প্রতিটি বাক্যে আছে ছন্দ, ধ্বনি, সুর। "তোমার সাথে আমার প্রতিটি বাক্যই যেন ছিল একেকটি কবিতা"—এই স্বীকারোক্তিই প্রকৃত সত্য। উদ্ধৃত কবিদের পঙক্তি আর নিজস্ব কাব্যিক প্রকাশ মিলে এগুলো দাঁড়িয়েছে গদ্যকবিতার চিঠি হয়ে। শুভ কামনা !
ReplyDeleteমুনা চৌধুরীর শুভাশীষকে চিঠি' পড়ে খুব ভাল লাগলো । বহুদিন অপেক্ষা করে অবশেষে শুভাশিসের চিঠির দেখা মিললো । খুই ভাল লাগছে । কবি সুনিকেতের পর আমার প্রিয় মুনা চৌধুরীর লেখা । চিঠিগুলো যেন এক জীবন্ত । প্রত্যেকটা লাইন দারুনভাবে আকৃষ্ট করে ।যদিও সবটুকু আমার বোধগম্য হয়নি ।তবে অনেক কিছু নতুন করে জানতে পারলাম ।অনেক ভাল থাকবেন অনেক অনেক ভালবাসা।
ReplyDeleteবহুদিন অপেক্ষার ফল মুনা চৌধুরীর শুভাশীষকে চিঠি' পড়ে খুব ভাল লাগলো । এখানে আত্মজৈবনিক ও ঐতিহাসিক স্তর মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। প্রেমিক-প্রেমিকার ব্যক্তিগত স্মৃতি বারবার ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের সাথে জড়িয়ে গেছে। জিন্নাহ-রুটটির কাহিনী, লিঙ্কনস ইন, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্রনাথের আবৃত্তি—সব মিলিয়ে এগুলো কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, বরং ব্যক্তিগত ইতিহাস ও জাতীয় ইতিহাসের সমান্তরাল ধারা। এর ফলে পাঠক একসাথে ব্যক্তিগত বেদনা আর সময়ের বৃহত্তর ট্র্যাজেডি অনুভব করে। এখানেই লেখকের সার্থকতা ।শুভ কামনা নিরন্তর !! খুব ভাল থাকবেন ।
ReplyDelete