আমি বিজয় দেখেছি — ব্যক্তিগত স্মৃতিতে ১৬ই ডিসেম্বর
সানজিদা রুমি
১৬ই ডিসেম্বর আমার কাছে কেবল একটি রাষ্ট্রীয় দিবস নয়; এটি ভয়, অপেক্ষা, হারানো মানুষ আর ফিরে পাওয়া পরিচয়ের ব্যক্তিগত স্মৃতি।
১৬ই ডিসেম্বর এলেই আমার ভেতরে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে। এই দিনটি আমার কাছে কোনো আনুষ্ঠানিক দিবস নয়, কোনো ক্যালেন্ডারের লাল দাগ নয়—এটি আমার জীবনের স্মৃতিতে গেঁথে থাকা একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা। আমি বিজয় দেখেছি, চোখে দেখেছি মানুষের ভয়, সাহস, অপেক্ষা আর শেষ পর্যন্ত মুক্তির আলো। আমি বিজয় দেখেছি, চোখে দেখেছি মানুষের ভয়, সাহস, অপেক্ষা আর শেষ পর্যন্ত মুক্তির আলো।
১৯৭১ সালের সেই সময়টা ছিল আতঙ্কে মোড়া। চারদিকে অনিশ্চয়তা, গুজব আর ভয়। দিনের আলোয়ও মানুষ কথা বলত সাবধানে, আর রাত নামলেই ঘরগুলো নিঃশব্দ হয়ে যেত। বাতি নিভিয়ে রাখা হতো, জানালার পর্দা টেনে দেওয়া হতো। যেন শব্দও তখন শত্রু। বড়রা ফিসফিস করে কথা বলত, আর আমরা শিশুরা বুঝে যেতাম—কিছু একটা খুব ভয়ংকর ঘটছে, কিন্তু তার নাম বলা যাচ্ছে না।
আমি দেখেছি কীভাবে যুদ্ধ মানুষের স্বাভাবিক জীবন ছিনিয়ে নেয়। হাটে-বাজারে পরিচিত মুখগুলো হঠাৎ আর দেখা যেত না। কেউ বলত, সে সীমান্তে গেছে; কেউ বলত, তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। প্রশ্ন করলে বড়রা চোখ নামিয়ে নিত। অনেক প্রশ্নের উত্তর তখন নীরবতাই ছিল।
তবু সেই নীরবতার ভেতরেও আশা ছিল। আমি দেখেছি মানুষ কীভাবে সাহস জোগাড় করে। যাদের হাতে ছিল লাঙল, তারা অস্ত্র ধরেছে। যাদের জীবনে কখনো যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল না, তারা বুক শক্ত করে দাঁড়িয়েছে। তারা জানত, এই লড়াই হারলে হারাতে হবে ভাষা, পরিচয় আর ভবিষ্যৎ। সেই উপলব্ধিই মানুষকে অদম্য করে তুলেছিল।
মায়েদের মুখে ছিল চাপা ভয়, কিন্তু চোখে ছিল দৃঢ়তা। অনেক মা ছেলেকে বিদায় দেওয়ার সময় কাঁদেননি। শুধু বলেছিলেন, ফিরে না এলে দেশের জন্য মরবে—এই কথাটুকুই তাদের শক্তি ছিল। আজও সেই দৃশ্যগুলো মনে পড়লে বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি এসে অপেক্ষা আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল। চারপাশে চাপা উত্তেজনা, গুঞ্জন—যুদ্ধ বুঝি শেষের পথে। কিন্তু কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছিল না। আমরা প্রতিটি খবরে কান পাততাম, আবার হতাশ হতাম। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝখানে দুলছিল সময়।
তারপর এলো সেই দিন—১৬ই ডিসেম্বর। সেদিনের আকাশ, বাতাস, মানুষের মুখ—সবকিছু আলাদা মনে হয়েছিল। প্রথমে খবরটা বিশ্বাস করতে পারিনি। যুদ্ধ শেষ? সত্যিই কি শেষ? একটু পর যখন নিশ্চিত হলো, তখন চারপাশে এক ধরনের স্তব্ধতা নেমে এলো। কেউ চিৎকার করে আনন্দ করেনি, কেউ উচ্ছ্বাসে ভেঙে পড়েনি। মানুষ একে অন্যের দিকে তাকিয়েছিল—চোখে জল, মুখে অল্প হাসি। মনে হচ্ছিল, আমরা বেঁচে গেছি, আবার অনেককেই চিরদিনের জন্য হারিয়েছি।
আমি প্রথমবার লাল-সবুজ পতাকা উড়তে দেখেছিলাম সেই দিন। সে পতাকা আমার কাছে তখন শুধু একটি দেশের প্রতীক ছিল না—ওটি ছিল রক্তে কেনা স্বাধীনতার চিহ্ন। মনে হয়েছিল, এই রঙের ভেতরে লুকিয়ে আছে অসংখ্য অচেনা নাম, অগণিত গল্প, আর না বলা অনেক কথা।
বিজয়ের আনন্দের মাঝেও শোক ছিল। যাদের ফেরার কথা ছিল, তারা ফেরেনি। অনেক ঘরে বিজয়ের দিনেও আলো জ্বলেনি। এই দ্বৈত অনুভূতিই হয়তো আমাদের বিজয়কে অন্যরকম করেছে—এটি আনন্দের, আবার গভীরভাবে বেদনাময়।
আমি বিজয় দেখেছি, তাই জানি—বিজয় মানে শুধু যুদ্ধ জেতা নয়। বিজয় মানে একটি জাতির আত্মমর্যাদা ফিরে পাওয়া। বিজয় মানে মাথা তুলে কথা বলার অধিকার। আর বিজয় মানে দায়িত্ব—এই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলার দায়িত্ব।
আজ ১৬ই ডিসেম্বর এলেই আমি নিজেকে প্রশ্ন করি—আমরা কি সেই ত্যাগের মর্যাদা রাখতে পেরেছি? আমরা কি অন্যায়ের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সোচ্চার? আমরা কি এই দেশটাকে ভালোবাসছি ঠিক সেই গভীরতায়, যেভাবে কেউ কেউ জীবন দিয়ে ভালোবেসেছিল?
আমি বিজয় দেখেছি। এই দেখা কেবল স্মৃতি নয়, এটি আমার দায়। যতদিন বেঁচে থাকব, এই দিনের কথা বলব—যাতে নতুন প্রজন্ম জানে, স্বাধীনতা কোনো উপহার নয়। এটি রক্তে লেখা ইতিহাস।
১৬ই ডিসেম্বর আমাদের শুধু আনন্দ শেখায় না, আমাদের মনে করিয়ে দেয়—এই দেশটা সহজে আসেনি। আর তাই একে ভালোবাসাও সহজ দায়িত্ব নয়।




লেখনীর সূত্রপাত শুরু এখান থেকে 







আমি বিজয় দেখেছি — ব্যক্তিগত স্মৃতিতে ১৬ই ডিসেম্বর সানজিদা রুমির এই লেখাটা পড়তে গিয়ে মনে হলো, ইতিহাসের বই নয়—একজন মানুষের হৃদয়ের ভেতর ঢুকে পড়েছি। খুব গভীর, খুব সত্য। বিজয়ের আনন্দের সঙ্গে যে শোক মিশে আছে, সেটাই সবচেয়ে স্পর্শ করেছে। লেখক শুধু ঘটনা বলেননি, সময়ের নীরবতা আর ভয়টাকে চোখের সামনে এনে দিয়েছেন। পড়তে গিয়ে গা শিউরে উঠেছে।আমি যুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু এই লেখা পড়ে মনে হলো—আমি যেন একটু হলেও অনুভব করতে পারলাম সেই সময়টা। অসাধারণ লেখা।
ReplyDelete"আমি বিজয় দেখেছি -ব্যক্তিগত স্মৃতিতে ১৬ই ডিসেম্বর" সানজিদা রুমির এই লেখাটা অসাধারণ লেখা। পড়ে খুব ভাল লাগলো। ‘বিজয় মানে দায়িত্ব’এই লাইনটা মনে গেঁথে গেল। আমরা হয়তো অনেক সময় এই দায়িত্বটা ভুলে যাই।
ReplyDeleteভাষা খুব সংযত, কিন্তু আবেগ প্রবল। কোনো বাড়তি নাটক নেই, তবু প্রতিটি অনুচ্ছেদ ভারী হয়ে আছে অনুভবে। মায়েদের নীরব শক্তির যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, সেটা পড়তে গিয়ে চোখ ভিজে গেছে। এই দিকটা খুব সুন্দরভাবে এসেছে।এক কথায় অনবদ্য।
"আমি বিজয় দেখেছি -ব্যক্তিগত স্মৃতিতে ১৬ই ডিসেম্বর" সানজিদা রুমির এই লেখাটা অসাধারণ অনবদ্য। পড়ে খুবই ভাল লাগলো। এই লেখা নতুন প্রজন্মের পাঠ্য হওয়া উচিত। কারণ এখানে শুধু ইতিহাস নয়, দায়বদ্ধতার কথাও আছে বিজয়কে শুধু উৎসব নয়, আত্মসমীক্ষার জায়গা হিসেবে দেখানোর জন্য লেখককে ধন্যবাদ। লেখাটা শেষ করে মনে হলো স্বাধীনতা নিয়ে গর্ব করার আগে আমাদের অনেক কিছু ভাবা উচিত। শক্তিশালী ও প্রয়োজনীয় লেখা। অনেক অনেক শুভ কামনা ।
ReplyDeleteসানজিদা রুমির লেখাটা পড়ে খুবই ভাল লাগলো। এই লেখাটা পড়া শেষ করে মনে হলো, আমি শুধু একটি লেখা পড়িনি । আমি একজন মানুষের স্মৃতির ভার বহন করলাম কিছু সময়ের জন্য। লেখক যেভাবে ভয়, নীরবতা আর অপেক্ষার দিনগুলোকে তুলে ধরেছেন, তা ইতিহাসের যেকোনো দলিলের চেয়েও জীবন্ত। এখানে কোনো স্লোগান নেই, কিন্তু প্রতিটি লাইনে দেশপ্রেম নিঃশব্দে কথা বলে।১৬ই ডিসেম্বরকে আমরা প্রায়ই উৎসবের রঙে ঢেকে ফেলি, কিন্তু এই লেখা সেই রঙের নিচে থাকা ক্ষতগুলো দেখিয়েছে। বিজয়ের আনন্দের সঙ্গে শোকের যে সহাবস্থান, সেটাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে সত্যিকারের ছবি। লেখাটি পড়তে গিয়ে বারবার থমকে যেতে হয়েছে। অনন্য । অনেক ধন্যবাদ আলোকরেখাকে এমন তথ্যবহুল লেখা প্রকাশ করার জন্য । লেখককে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
ReplyDelete"আমি বিজয় দেখেছি -ব্যক্তিগত স্মৃতিতে ১৬ই ডিসেম্বর" সানজিদা রুমির লেখাটা পড়ে খুবই ভাল লাগলো। লেখকের স্মৃতিচারণে সবচেয়ে শক্তিশালী দিকটি হলো তিনি ‘আমি’ বলেই একটি জাতির ‘আমরা’কে তুলে ধরেছেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হয়েও এটি সামষ্টিক ইতিহাস হয়ে উঠেছে। এই ধরনের লেখা সময় পেরিয়ে দলিল হয়ে থাকে। অনন্য লেখনী । এই বিজয় দিবসের ভালবাসা আলোকরেখার সকল পাঠক, লেখক ও কবিদের । সবাই ভাল থাকুন ।
ReplyDelete"আমি বিজয় দেখেছি -ব্যক্তিগত স্মৃতিতে ১৬ই ডিসেম্বর" সানজিদা রুমির স্মৃতিচারণে যুদ্ধ দেখেনি এমন একজন পাঠক হিসেবেও আমি এই লেখার ভেতরে ঢুকে পড়েছি। বড়দের ফিসফিসানি, নিভু নিভু আলো, অজানা আতঙ্ক সবকিছু এত বাস্তবভাবে এসেছে যে মনে হয়েছে, আমি নিজেও সেই ঘরের এক কোণে বসে আছি। মায়েদের নীরব শক্তির যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা অসম্ভব শক্তিশালী। কোনো অতিরঞ্জন ছাড়াই লেখক দেখিয়েছেন কীভাবে কান্না না করে সন্তানকে বিদায় দেওয়া ছিল সবচেয়ে বড় সাহসের পরিচয়। এই অংশটা পড়তে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখা কঠিন ছিল। এই লেখার ভাষা খুব সংযত, কিন্তু অনুভূতির গভীরতা অসীম। কোথাও অপ্রয়োজনীয় আবেগ নেই, তবু প্রতিটি অনুচ্ছেদ পাঠকের বুকে ভারী হয়ে বসে। এটাই পরিণত লেখার পরিচয়।
ReplyDelete"আমি বিজয় দেখেছি -ব্যক্তিগত স্মৃতিতে ১৬ই ডিসেম্বর" সানজিদা রুমির অসাধারন লেখা ।‘বিজয় মানে দায়িত্ব’ এই উপলব্ধিটি পুরো লেখার মেরুদণ্ড। লেখক শুধু স্মৃতিচারণ করেননি, তিনি বর্তমান প্রজন্মের সামনে আয়না ধরেছেন। আমরা কি সত্যিই সেই আত্মত্যাগের যোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছি ? এই প্রশ্নটা লেখাটা শেষ হওয়ার পরও তাড়া করে। এই লেখাটি পড়িয়ে দেওয়া উচিত স্কুল-কলেজে। কারণ এখানে শুধু যুদ্ধজয়ের গল্প নেই, আছে স্বাধীনতার নৈতিক ভার। নতুন প্রজন্ম বুঝতে পারবে স্বাধীনতা মানে শুধু অধিকার নয়, দায়িত্বও। লেখক বিজয়কে শুধু কোনো উচ্ছ্বাসের মুহূর্ত হিসেবে দেখাননি, বরং এক ধরনের নীরব উপলব্ধি হিসেবে তুলে ধরেছেন। সেই স্তব্ধতার বর্ণনা অসাধারণ যেখানে আনন্দ, শোক আর ক্লান্তি একসঙ্গে মিশে আছে। অপূর্ব !!!
ReplyDelete