বেগম রোকেয়া: নারীজাগরণের ইতিহাসে প্রথম আলোর দীপশিখা
বাংলার নারীজীবনের ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে, যাদের উপস্থিতি শুধু সময়কে বদলায়নি, বদলে দিয়েছে সমাজের ভিত, চিন্তার ভিত্তি এবং মানবতার দৃষ্টিভঙ্গি।ইতিহাসের পাতা কখনো কখনো এক অসাধারণ মানুষকে এমনভাবে ধারণ করে, যেন তিনি একাই একটি যুগের মানচিত্র বদলে দেন। উনিশ ও বিশ শতকের সেই আলো-অন্ধকারের সন্ধিক্ষণে বাঙালি মুসলিম সমাজের এক ঘন কুয়াশার সময়ে জন্ম নিয়েছিলেন যে নারী, তিনি আজ ইতিহাসে সুস্পষ্ট অগ্রদ্যুত—বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তাঁর জন্ম যেন সময়কে চ্যালেঞ্জ করা এক আলোককণা, আর তাঁর যাপন ছিল অশ্রুত, অবদমিত, বাঁধনমুক্তির সংগ্রামে নির্মিত এক মহাকাব্যের মতো। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাদের মধ্যেই অন্যতম—বরং সর্বাগ্রে। তিনি ছিলেন নারীশিক্ষার বীজতলা, মুসলিম নারীর আত্মমর্যাদার প্রথম উচ্চারণ, এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুক্তির ধারালো অস্ত্র। উনিশ শতকের শেষদিকে, যখন নারী ছিল গৃহবন্দী, অশিক্ষা ছিল নিয়মের মতো স্বীকৃত, এবং কুসংস্কার ছিল রীতির মতো স্বাভাবিক, ঠিক তখনই রোকেয়া দাঁড়িয়েছিলেন প্রতিরোধের প্রথম সারিতে। তাঁর হাতে ছিল কলম, হৃদয়ে ছিল দৃঢ় বিশ্বাস—শিক্ষাই মানবমুক্তির একমাত্র পথ।
রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে রংপুরের
পায়রাবন্দ গ্রামে। জমিদার পরিবার হলেও পরিবেশ ছিল রক্ষণশীল; নারীর ঘরবন্দী জীবনকে তখনকার সমাজে স্বাভাবিক বলেই
বিবেচনা করা হতো। মেয়েদের লেখাপড়া শেখা নাকি ‘অনুচিত’, ‘অশোভন’,
‘ধর্মবিরোধী’—এমনই নানা
যুক্তির বেড়াজালে আটকে ছিল শিক্ষার দরজা। এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও রোকেয়ার বড় ভাই
ইব্রাহিম সাবের তাঁকে গোপনে বাংলা ও ইংরেজি শেখান। এই গোপন শিক্ষাই তাঁর
জীবনচেতনার ভিতকে দৃঢ় করে তোলে। তিনি বুঝতে পারেন, নারীর
অশিক্ষা কোনও প্রাকৃতিক নিয়ম নয়;
এটি কৃত্রিমভাবে চাপিয়ে
দেওয়া একটি সামাজিক অবরোধ। আর এই অবরোধ ভাঙতে হলে চাই জ্ঞান, যুক্তি,
আলো—চাই সাহস।
বিয়ের পর রোকেয়ার জীবনে আসে নতুন মাত্রা। তাঁর স্বামী
সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন শিক্ষিত,
উদারচিন্তার মানুষ। তিনি
বুঝতেন—নারীর শিক্ষা শুধু পরিবারের জন্যই নয়,
সমাজের সামগ্রিক উন্নতির
জন্য জরুরি। স্বামীর উত্সাহেই রোকেয়া কলম হাতে তুলে নেন। শুরু হয় প্রবন্ধ, গল্প,
উপন্যাস লেখার মধ্য দিয়ে
সামাজিক চিন্তার নতুন উন্মেষ। কিন্তু এই পথ ছিল একেবারেই মসৃণ নয়। সমাজের রক্ষণশীল
অংশ নানা বিদ্বেষ, কটূক্তি ও অবমাননা ছুড়ে দিয়েছিল তাঁর দিকে।
তবুও তিনি থামেননি; বরং প্রতিটি দিন তাঁর সংগ্রামকে আরও তীক্ষ্ণ
করে তুলেছে।
স্বামীর মৃত্যুর পর প্রায় একা হাতে রোকেয়া শুরু করেন
নারীশিক্ষা আন্দোলনের ভিত্তি রচনা। ১৯১৬ সালে কলকাতায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল, যেখানে প্রথমে মাত্র ছয়জন ছাত্রী ছিল। কিন্তু সমালোচনা, বাধা ও আর্থিক সংকটকে অগ্রাহ্য করে তিনি স্কুলটিকে দাঁড়
করিয়েছিলেন দৃঢ়তায়, পরিশ্রমে ও অদম্য নীতিবোধে। তাঁর শিক্ষাদর্শ
ছিল অনন্য—মেয়েদের শুধু পড়তে শেখানো নয়,
বরং আত্মসম্মান, যুক্তিবোধ,
স্বনির্ভরতা ও মানবিকতা
শেখানো। তাঁর মতে, শিক্ষিত নারীই পারে পরিবারকে পরিবর্তন করতে, সমাজকে আলোকিত করতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক পথে
এগিয়ে নিতে।
রোকেয়ার সাহিত্যকর্ম তাঁর জীবনসংগ্রামের মতোই তীক্ষ্ণ
অথচ মানবিক। তাঁর ইংরেজি গল্প
“Sultana’s Dream” শুধু নারীবাদী সাহিত্যেই নয়, বিশ্বসাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য কল্পবিজ্ঞান রচনা। গল্পের
‘লেডিল্যান্ড’-এ নারীরা এগিয়ে বিজ্ঞান,
স্বাধীনতা ও শাসনক্ষমতায়; আর পুরুষরা থাকে ঘরবন্দী। এই ব্যঙ্গাত্মক বিন্যাস
নারী-পুরুষের ভূমিকা নিয়ে সমাজের তৈরি করা কৃত্রিম কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
রোকেয়া যেন বলতে চেয়েছেন—যদি সমাজে নারীর স্বাধীনতা ‘স্বাভাবিক’ বলে বিবেচিত হতো, তবে আমাদের কাছে এ দৃশ্যও অস্বাভাবিক মনে হতো না। সমাজের
ধারণাই নির্ধারণ করে কে স্বাধীন হবে,
কে বন্দী।
তাঁর আরেকটি অসাধারণ রচনা ‘অবরোধবাসিনী’, যেখানে তিনি বাস্তব জীবনের পর্দাবন্দী নারীদের গল্প
সংগ্রহ করেছেন। এসব গল্পে ফুটে উঠেছে সমাজের কঠোর চেহারা—যেখানে নারীকে মানুষ
হিসেবে নয়, বরং পরিবার ও সমাজের ‘সম্মানরক্ষার বস্তু’
হিসেবে দেখা হতো। রোকেয়া যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, প্রকৃত ধর্ম নারীর অগ্রগতির বিরোধী নয়; বরং সমাজের তৈরি কুসংস্কারই নারীর প্রকৃত শত্রু।
‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও
আত্মনির্ভরতার গুরুত্ব। সমাজের বহু স্তরের নারী—গৃহবধূ, বঞ্চিতা,
অবহেলিত, নির্যাতিতা—সবাইকে তিনি দেখেছেন সমান মানবিক চোখে। তাঁর
লেখায় বারবার উঠে আসে মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বোধের প্রশ্ন।
রোকেয়ার সমাজসংগঠনের কাজও ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ। তিনি
প্রতিষ্ঠা করেন
আঞ্জুমান-এ-খাওয়াতিনে
ইসলাম, যেখানে নারীদের আত্মশিক্ষা, অধিকার,
স্বাস্থ্য, বিবাহসংক্রান্ত ঝুঁকি, আর্থিক
দক্ষতা—এসব বিষয়ে সচেতন করা হতো। তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন, সভা আয়োজন করেছেন,
কলমে-ভাষণে সমাজকে প্রশ্ন
করেছেন। তাঁর আন্দোলন ছিল শব্দহীন বিপ্লব;
কিন্তু তার প্রতিধ্বনি আজও
শোনা যায়।
১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর, নিজের
জন্মদিনেই বেগম রোকেয়া পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। যেন তাঁর জীবনচক্র নিজের ভিতরেই
সম্পূর্ণ হলো। জন্ম ও মৃত্যু যখন একই দিনে মেলে, তখন
তা কাকতালীয় নয়—এ যেন সময়ের প্রতি তাঁর রেখে যাওয়া এক অক্ষয় বার্তা: তিনি এসেছিলেন
আলো জ্বালাতে, আর তাঁর আলো নিভে যাওয়ার নয়।
সময়ের বহমান স্রোতে বহু নাম হারিয়ে যায়। কিন্তু বেগম
রোকেয়া সেই বিরল মানুষদের একজন,
যাঁর কাজ, চিন্তা ও সংগ্রাম যুগ বদলায়। তিনি ছিলেন শিক্ষার বাতিঘর, যুক্তির ধারালো কলম, এবং
অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরব অথচ প্রখর প্রতিবাদ। তাই তিনি শুধু নারীর অগ্রদ্যুত
নন—তিনি সমাজজাগরণের চিরন্তন সভ্যতার আলো।




লেখনীর সূত্রপাত শুরু এখান থেকে 







তোমার লেখার ভাষা অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও আবেগনির্ভর। বিশেষ করে প্রথম অনুচ্ছেদে তুমি বেগম রোকেয়াকে যেভাবে “সময়ের চ্যালেঞ্জ করা আলোককণা” বা “এক মহাকাব্যের মতো” বলে তুলনা করেছ, তা লেখাটিকে শুধু তথ্যমূলক রাখেনি । বরং পাঠকের মনে এক নান্দনিক ও ইতিহাসবোধ জাগিয়ে তোলে। ইতিহাসভিত্তিক রচনায় এমন রূপক প্রয়োগ পাঠককে আকৃষ্ট করে, কিন্তু এখানে তা মাত্রাতিরিক্ত বা কৃত্রিম লাগেনি। বরং লেখাটির শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছে।
ReplyDeleteঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট চিত্রণে গভীরতার প্রশংসার দাবীদার । উনিশ ও বিশ শতকের সামাজিক অন্ধকার, নারীশিক্ষার সীমাবদ্ধতা, পুরুষতান্ত্রিকতার কঠোর বাস্তবতা—এসব বিষয়কে খুব পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন। রোকেয়ার অবদান বোঝার জন্য এই প্রেক্ষাপট অত্যন্ত জরুরি, আর সেই কাজটি সফলভাবে করেছেন। বিশেষ করে মুসলিম সমাজে নারীশিক্ষার প্রতি বিদ্বেষের কথা তুলে ধরে পাঠকের কাছে প্রশ্ন জাগিয়েছ: কীভাবে একজন নারী এত প্রতিকূলতার মধ্যেও আন্দোলন শুরু করতে পারলেন? খুব ভাল লাগলো।
ReplyDeleteরোকেয়ার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপ শিক্ষা, সাহিত্য, সংগঠন, সমালোচনা, সামাজিক বাধা এসব ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কোথাও তাড়াহুড়া নেই, কোথাও অপ্রয়োজনীয় পুনরুক্তি নেই। পাঠক সহজেই দেখতে পায় কীভাবে একটি ব্যক্তিজীবন থেকে একটি সমাজ-পরিবর্তনের আন্দোলন জন্ম নিয়েছিল।সমাপ্তির নৈতিক বার্তাটি অত্যন্ত শক্তিশালী ।“তিনি শুধু নারীর অগ্রদ্যুত নন—তিনি সমাজজাগরণের চিরন্তন সভ্যতার আলো”এটি লেখার সবচেয়ে প্রভাবশালী সারমর্ম। এতে দেখা যায় যে লেখক বেগম রোকেয়ার অবস্থানকে নারীমুক্তির সীমার বাইরে নিয়ে গিয়ে বৃহত্তর মানবমুক্তির পরিসরে স্থাপন করেছে। এই বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি একটি ইতিহাসভিত্তিক প্রবন্ধকে চিরন্তন তাৎপর্য দেয়। অনেক শুভেচ্ছা ।
ReplyDeleteলেখাটি পড়তে গিয়ে মনে হলো ইতিহাস যেন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
ReplyDeleteবেগম রোকেয়ার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এত সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল যেন সেই যুগের আঁধার, সংগ্রাম আর আলো জ্বলা দৃশ্যগুলো নিজে দেখছি। বিশেষ করে তাঁর শৈশব, ভাইয়ের গোপনে শেখানো শিক্ষার কথা, আর সেই রক্ষণশীল সমাজের ভেতর আলো খোঁজার গল্প—সবকিছুই অত্যন্ত জীবন্ত। ইতিহাসের প্রবন্ধ সাধারণত কঠিন কিংবা শুষ্ক হয়, কিন্তু এই লেখায় আবেগের অনুরণন বিদ্যমান । পাঠক হিসেবে তা আমাকে গভীরভাবে ছুঁয়েছে। আগে “Sultana’s Dream” বা “অবরোধবাসিনী” সম্পর্কে জানতাম, কিন্তু লেখক যেভাবে তাদের সামাজিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন।বিশেষ করে লেডিল্যান্ডের ব্যঙ্গাত্মক রূপটিকে তা আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছে। রোকেয়া শুধু লেখেননি।তিনি কলমের মাধ্যমে সমাজকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়েছিলেন । এই ব্যাখ্যা তা নতুনভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে। অত্যন্ত মান সম্মত লেখা। যা আমরা আলোকরেখায় পাই । ভাল থাকবেন সবাই ! অনেক অনেক শুভ কামনা ।
লেখার ভাষা এতই মসৃণ যে কোথাও পড়তে একঘেয়েমি লাগেনি। বিষয়টি যে খুব গুরুতর ও গবেষণাভিত্তিক, তা জানা সত্ত্বেও পুরো লেখাটি কখনো ভারী মনে হয়নি। প্রবাহমান, মনোমুগ্ধকর, আবার তথ্যসমৃদ্ধ এই তিনটি গুণ একইসঙ্গে বজায় রাখা কঠিন। পাঠক হিসেবে আমি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পড়েছি, এবং পড়ার পরেও মনে হয়েছে আরো পড়ার মতো কিছু থাকলে ভালো হতো।একজন পাঠক হিসেবে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো এই লেখা আমাকে শুধু তথ্য দেয়নি, বরং আমাকে বদলে দিয়েছে। মনে হয়েছে, সমাজে এখনো অনেক অন্ধকার আছে, আর আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই রোকেয়ার সাহসের একটি ক্ষুদ্র অংশ থাকা উচিত। এমন লেখা মানুষকে শুধু জ্ঞানী নয়—সচেতন ও মানবিক করে তোলে।খুব ভাল লেগেছে । ভাল থেক!!!
ReplyDelete