“বিজয়ের ডিসেম্বর: রক্তাক্ত স্মৃতি, দীপ্ত ভবিষ্যতের শপথ”
সানজিদা রুমি
ডিসেম্বরের হিমেল বাতাস যতই কোমলভাবে বয়ে যায়, ততই যেন বাঙালির হৃদয়ে পুনরুজ্জীবিত হয় এক অগ্নিগর্ভ ইতিহাস। এই ডিসেম্বর শুধু ক্যালেন্ডারের একটি মাস নয়—এ মাসে বাংলার প্রতিটি ইঞ্চি মাটি হয়ে ওঠে স্মৃতির অগ্নিগর্ভ প্রহরী। এখানে আছে কান্না, আছে রক্ত, আছে অবর্ণনীয় বেদনা; আবার একইসঙ্গে আছে গৌরবের সূর্যজ্জ্বল শিখা, আছে অবিনাশী শান্তির পতাকা। বিজয়ের ডিসেম্বর এমন এক গণহর্ষ, যা একটি জাতির আত্মাকে রূপ দেয়—কেবল পরাধীনতার শেকল ভাঙার মাধ্যমে নয়, অমানুষিক নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অদম্য সাহসের মধ্য দিয়ে।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর ছিল দুঃসহতার চূড়ান্ত অধ্যায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতা তখন বাঙালির বুকের ওপর এক অভিশপ্ত কালো পাহাড় হয়ে নেমে এসেছিল। গ্রামে গ্রামে আগুন জ্বলেছে, ঘরবাড়ি পুড়েছে, শিশুদের কান্না স্তব্ধ হয়ে গেছে গোলাগুলির শব্দে। এদেশীয় দোসর জামাত-রাজাকার-আল-বদররা ছিল সেই আগুনে ঘি ঢালা হাত—যারা বাংলার মাটিকে রক্তাক্ত করার নীলনকশা সাজিয়েছে নিষ্ঠুর উল্লাসে। নিরীহ মানুষের আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে; নদীর জলে গলে গেছে মানুষের মৃতদেহ, লাশের গন্ধে জেগে উঠেছে ভয়ার্ত অন্ধকার।
এইসব অন্ধকারের মধ্যেই বাঙালি খুঁজে পেয়েছিল আলো—এক অদম্য, অটল, অনমনীয় আলোর নাম স্বাধীনতা।
যে জাতির ওপর দুঃখের বোঝা এত ভারী, সেখানেও জন্ম নেয় প্রতিরোধ। প্রতিটি গেরিলা হামলায়, প্রতিটি মাটির ঘরে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধার গর্জনে, প্রতিটি মায়ের সন্তান হারানো ক্রন্দনে যেন শপথ উচ্চারিত হয়েছিল—
“বাংলা বাঁচবে। বাংলা স্বাধীন হবেই।”
বিজয়ের ডিসেম্বর আমাদের শেখায়: আগ্রাসন যতই শক্তিশালী হোক, অত্যাচার যতই ভয়ঙ্কর হোক—একটি জাতির আত্মশক্তি যদি জেগে ওঠে, তবে তাকে কোনো শক্তিই পরাজিত করতে পারে না।
কিন্তু বিজয়ের এই আলো আসেনি সহজে। এসেছে নদীর মতো বয়ে যাওয়া রক্তের মধ্য দিয়ে। এসেছে শহীদদের নিস্পাপ দেহের উপর দিয়ে। এসেছে অসংখ্য নারীর ত্যাগের কান্না, শোক, লাঞ্ছনার পরেও মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার পাশে দাঁড়িয়ে। এসেছে বিপন্ন মানুষের দুঃস্বপ্নের মাঝেও জীবনের জন্য লড়াই করার অঙ্গীকার নিয়ে।
১৩ থেকে ১৪ ডিসেম্বর রাত—যা ইতিহাসে ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস’ নামে চিহ্নিত—ছিল বাঙালির বেদনাবিধুরতম রাত্রি। আল-বদরদের তালিকাভুক্ত পরিকল্পনায় দেশের শ্রেষ্ঠ চিন্তক, লেখক, কবি, শিক্ষক, চিকিৎসকদের একে একে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল পরিষ্কার: বাঙালিকে মগজশূন্য করে দেওয়া, যেন বিজয়ের পরেও দাঁড়িয়ে না উঠতে পারে। এ ছিল ভয়াবহ, নৃশংস, অমানবিক অপরাধ—যার ক্ষত সময়ের বহু চক্র পরিবর্তনের পরেও শুকায়নি। এই ডিসেম্বরের বাতাসে সেই শোকঘন রাতের কান্না আজও থমকে থাকে।
আর সেই অন্ধকারের ঠিক ৪৮ ঘণ্টা পর—
১৬ ডিসেম্বর, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যখন পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের দলিলে সই করল, তখন পৃথিবী নতুন করে দেখল এক জাতির জন্ম। এক দেশ, যার নাম বাংলাদেশ।
বিজয়ের লাল-সবুজ পতাকা যেমন শত্রুর পরাজয়ের প্রতীক, তেমনি এটি অনন্ত শপথের চিহ্ন—
আমরা বাঙালি মাথা নত করি না।
আমরা হার মানি না।
আমরা আলো সৃষ্টি করি গভীরতম অন্ধকারের ভেতর থেকেও।
আজও তাই ডিসেম্বর আমাদের ডাক দেয়—
ইতিহাস ভুলে যেও না।
শহীদদের রক্ত ভুলে যেও না।
মুক্তিযোদ্ধাদের শপথ ভুলে যেও না।
বাংলার পতাকার মান—এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে যেও না।
স্বাধীনতা কেবল অর্জনের বিষয় নয়—এটি রক্ষা করার প্রতিনিয়ত দায়িত্ব।
বিজয় শুধু উৎসব নয়—এটি দেশের প্রতি ভালোবাসা, সততা, ন্যায় ও মানবিকতার সার্বক্ষণিক প্রতিজ্ঞা।
বিজয় শুধু অতীতের গৌরব নয়—এটি ভবিষ্যতের পথনির্দেশ, আজকের প্রজন্মকে সতর্ক করার স্থায়ী আহ্বান।
ডিসেম্বর তাই বেদনাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করার মাস।
ঘৃণা নয়—সত্য ও সাহসে দাঁড়ানোর মাস।
বিভক্তি নয়—বাংলার জন্য একসাথে হেঁটে যাওয়ার মাস।
বিজয়ের ডিসেম্বর আমাদের শেখায়—
যে জাতি শহীদের রক্তে জন্ম নেয়, তাকে পরাজিত করার শক্তি এই দুনিয়ায় নেই।
বাংলাদেশ সেই জাতি—অমর, অবিনাশী, অপরাজেয়।




লেখনীর সূত্রপাত শুরু এখান থেকে 







সানজিদা রুমির “বিজয়ের ডিসেম্বর” প্রবন্ধে বর্ণিত হয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বেদনাবিধুর ইতিহাস, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্মম বর্বরতা, বুদ্ধিজীবী হত্যার ভয়াল রাত, এবং স্বাধীনতা অর্জনের অসীম ত্যাগ। ডিসেম্বর কেবল বিজয়ের মাস নয়—এটি স্মৃতি, শোক, প্রতিজ্ঞা এবং ভবিষ্যৎ নির্মাণের শপথের প্রতীক। লেখাটি তুলে ধরে যে স্বাধীনতা রক্তে অর্জিত, তাই এটি রক্ষা করা প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। জাতির আত্মশক্তি ও ঐক্যই বাঙালিকে অপরাজেয় করে তুলেছে, এবং ডিসেম্বর সেই শক্তির চিরন্তন স্মারক।
ReplyDeleteসানজিদা রুমি “বিজয়ের ডিসেম্বর” প্রবন্ধ পড়ে খুব ভালো লাগলো । এমন একটা ইতিহাসকে প্রবন্ধে রুপ দেওয়া প্রশংসনীয় । তবে এখানে ইতিহাসের একটু কমতি আছে । ভারতের সাহায্য ছাড়া কি এই বিজয় সম্ভব ছিল ? তাছাড়া আমাদের অনেক সামরিক বাহিনীর অফিসার আর জাওয়ান্দের আত্মত্যাগ তুলে ধরা হয়েনি । এছাড়া লেখনির বুনিয়াদ গাঁথুনি প্রশংসার দাবিদার।
ReplyDeleteসানজিদা রুমির “বিজয়ের ডিসেম্বর” প্রবন্ধ পড়ে খুব ভালো লাগলো । ইতিহাসের আবেগময় পুনরুজ্জীবন প্রস্ফুটিত হয়েছে এই লেখায় ।লেখাটি ডিসেম্বর মাসকে শুধু ক্যালেন্ডারের সময় হিসেবে নয়, বরং বাঙালির আবেগ, স্মৃতি ও জাতির আত্মার সাথে জড়িত একটি জীবন্ত ইতিহাস-সময়েরূপে তুলে ধরেছে। ভাষা অত্যন্ত আবেগঘন, যা পাঠককে ১৯৭১–এর ভিতর টেনে নিয়ে যায়। খুবই উচ্চ মানসম্পন্ন লেখা ।সানজিদা রুমিকে অনেক অনেক অভিনন্দন এমন একটি লেখা উপহার দেবার জন্য ।ভাল থাক !
ReplyDeleteরুমি তোমার এই ওয়েব সাইটের পত্রিকা আমার খুব প্রিয় ।সময় পেলে শরীর ভাল থাকলে পড়ি ।মন্তব্য করা হয়ে ওঠেনি । আজ এই লেখাটি য়ামার অন্তরে যেয়ে লেগেছে । দেশের এই চরম দুর্দিনে যখন আমরা ৭১'র কে ভুলতে বসেছি এমন সময় এই ইতিহাস তুলে ধরা বাঞ্ছনীয় । বর্বরতার বাস্তব চিত্রায়ন করেছ তাও প্রশংসনীয় । এগুলোর প্রতক্ষ্য সাক্ষী আমি । গণহত্যা, গ্রাম পোড়ানো, শিশুদের কান্না, নদীতে ভাসমান লাশ—এই সব বর্ণনা মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতাকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছ। এতে পাঠকের মনে যুদ্ধের নির্মমতার বাস্তব উপলব্ধি তৈরি হয়। ।অনেক ভাল থেকো ,অনেক অনেক দোয়া তোমার জন্য ।
ReplyDeleteবুদ্ধিজীবী হত্যার বিশ্লেষণ অত্যন্ত শক্তিশালী এই লেখাতে। ১৩–১৪ ডিসেম্বর রাতের ঘটনাকে লেখক যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা হৃদয়বিদারক এবং বিশ্লেষণমূলক। বুদ্ধিজীবী নিধনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য“জাতিকে মগজশূন্য করা”লেখাটিকে আরও গভীরতা দিয়েছে। সানজিদা রুমির “বিজয়ের ডিসেম্বর” প্রবন্ধ পড়ে খুব ভালো লাগলো । যুদ্ধের অন্ধকারের বিপরীতে স্বাধীনতা অর্জনের আলোকে যে ভাষায় তুলনা করা হয়েছে, তা লেখাটিকে কাব্যিক ও শক্তিশালী করেছে। “অন্ধকারের ভেতর থেকেও আলো সৃষ্টি”এই বার্তা অনুপ্রেরণাদায়ী। বর্তমান প্রজন্মকে দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া লেখাটি শুধু অতীত নয় বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সতর্কতা ও দায়বদ্ধতার বার্তা দেয়। স্বাধীনতা শুধু উৎসব নয়।এটি ন্যায়, সততা ও মানবিকতার শপথ।এই বক্তব্য অত্যন্ত সময়োপযোগী।
ReplyDeleteসানজিদা রুমির “বিজয়ের ডিসেম্বর” প্রবন্ধ পড়ে খুব ভালো লাগলো । ভাষা ও উপস্থাপনায় শক্তিশালী দেশপ্রেম প্রকাশিত হয়েছে এই লেখায় । উত্তেজনাপূর্ণ, কাব্যিক, গদ্য-কবিতার মতো শৈলী লেখাটিকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। দেশপ্রেম, গৌরব ও শোক সবই ভারসাম্য রক্ষা করে ফুটে উঠেছে, যা পাঠকের মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে। খুব সুন্দর সময়োপযোগী লেখা । আমি আলোকরেখার একজন ভক্ত পাঠক ও গঠনমূলক মন্তব্য করি । শুধু দৃষ্টি নন্দন নয় এখানে মনের খোরাক পাওয়া যায় ।অনেক অনেক শুভকামনা ।
ReplyDelete